প্রতিষ্ঠান পোড়ে, পোড়ে না বিবেক!

শিক্ষাঙ্গনে আগুন
নির্বাচন ঠেকানো ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের নামে কোরআন শরিফ পোড়ানো হলো, শহীদ মিনার ভাঙা হলো, মন্দির ভাঙা হলো, জাতীয় পতাকা পোড়ানো হলো আর প্রতিনিয়ত মানুষ মারা হচ্ছে অস্ত্রে, আগুনে। বাকি ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া। রাজনীতির দগদগে আগুনে পুড়ছে সময়, শ্রম, অর্থ, পুড়ছে জীবন্ত মানুষ। আর এবার পোড়ানো হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়েছে, তার সংখ্যা প্রায় ২০০ জানা গেলেও তা আরও বেশি বলেই মনে করা হচ্ছে। শিক্ষা ধ্বংস হোক—এটাই চায় একশ্রেণীর মানুষ। যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে, তাদের দুর্বৃত্ত বললে হালকা করে বলা হয়। আমরা সাধারণ মানুষ জোট-মহাজোট বুঝি না। আমরা দেশ বুঝি, দেশের মানুষ বুঝি। ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়া বুঝি না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস বুঝি। হায় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানে কি নিষ্ঠুরতা?
পাথরহূদয় রাজনীতিক? টিভি খুলতে ভয় হয়, পেপার খুলতে ভয় হয়। কোনো বীভৎস খবর যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি’, যা আমাদের জাতীয় সংগীত। দেশমাতা আজ ডুকরে কাঁদছে, পুড়ে অঙ্গার আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অথচ রাষ্ট্রের অভিভাবকেরা নির্বিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়াকে আমরা আক্ষরিক ও প্রতীকী, দুই অর্থেই বিবেচনা করতে পারি। আক্ষরিক অর্থে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো পুড়েছে, সেগুলোর ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় এক রকম। আর যদি প্রতীকী অর্থে বিবেচনা করা যায়, তাহলে অন্য রকম। শিক্ষার প্রতি অবরোধকারীদের ক্ষোভ লক্ষণীয়। তারা পরীক্ষার দিনগুলোতে টানা অবরোধ দিয়ে পরীক্ষা ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। তা সত্ত্বেও সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ের সব পরীক্ষা শেষে যথাসময়ে ফল প্রকাশ করে স্কুলগুলোতে বই পৌঁছে দিয়েছে। হরতাল-অবরোধ সত্ত্বেও শিক্ষাবর্ষের প্রথম কার্যদিবসেই বই তুলে দেওয়া হলো শিক্ষার্থীদের কাছে। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার অর্থ শুধু ভোট বন্ধ করা নয়। একটি ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার কারণে যদি সেখানে মেরামত করে ভোট নেওয়া যায়, তাহলে ভোট হবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ওই কেন্দ্রে ভোট স্থগিত থাকবে। এতে করে ভোট বন্ধ হলো না, কিন্তু ক্ষতি হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়ার কারণে যে ক্ষতি হলো, তার প্রভাব পড়বে শিক্ষার ওপর। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন, তার চেয়ে হয়তো কিছু বেশি মানুষ ভোট দিতে আসতেন। আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে কিছু ভোটার কেন্দ্রে আসেননি। কিন্তু এতে করে নির্বাচন তো বন্ধ হলো না। জনগণ হরতাল-অবরোধ মানে না, মানতে বাধ্য করা হয়। যাঁরা ভোট দিতে চান, তাঁদের না দেওয়ার জন্য বাধ্য করতে আতঙ্ক সৃষ্টির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া কি একটু চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে পারবেন—তাঁর প্রিয় বিদ্যাপীঠ দিনাজপুর মিশন স্কুল কিংবা দিনাজপুর গার্লস স্কুল পুড়ে যাচ্ছে, শেখ হাসিনা কি কল্পনা করতে পারবেন, তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় পুড়ে যাচ্ছে বৈরী রাজনীতিরই কারণে। রাজনীতিকদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে, তাদের জন্য না হয় দেশে বিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ, গ্রামের মানুষের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে? নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যতই বিবাদ থাকুক, নির্বাচন ঠেকাতে বিরোধী দল যতই হরতাল-অবরোধ ডাকুক, তাই বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন, শিক্ষার্থীদের বই ও আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেওয়া কী ধরনের রাজনীতি? এর মাধ্যমে বিরোধী দল কী ফায়দা তুলে নিতে চায়? যদি প্রশ্ন তুলি, যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি সেই নির্বাচন প্রতিহত করা কিংবা প্রতিরোধ করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়ার কী প্রয়োজন? বিরোধী দল নির্বাচন বন্ধ করতে না পেরে সব আক্রোশ ঝেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। এটি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। তারা তো নির্বাচন বন্ধ করতে পারল না। তাহলে নির্বাচন বন্ধ করার চেষ্টায় যে দীর্ঘ অবরোধ দীর্ঘ প্রাণহানি হলো, আমাদের শিক্ষা-অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলো, 
এই দায় কে নেবে? ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ বলেছেন, দশম সংসদ নির্বাচনের পর বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে। তাঁদের কাছে আমাদের প্রশ্ন, যদি শুধুই সংবিধান রক্ষার নামে একটি নির্বাচন হয়, তাহলে সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল, এত সম্পদ নষ্ট হলো, তার দায় তাঁরাও এড়াতে পারেন না। তবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক সরকার বা বিরোধী দল নয়। এগুলোর মালিক জনগণ। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষায় তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। যারা আমাদের বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয়, তাদের আমরা সমর্থন দিতে পারি না। আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, জোটকে না বলার অর্থ মহাজোটকে হ্যাঁ বলা নয়। মহাজোটকে না বলার অর্থ জোটকে হ্যাঁ বলা নয়। সাধারণ মানুষের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে, যারাই শিক্ষাশত্রুতে পরিণত হবে, তাদেরই ‘না’ বলা। আমরা যদি শিক্ষাশত্রুদের চিহ্নিত করতে না পারি, তাহলে দেশে নাশকতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। বাড়তে থাকবে দগ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ড নির্মাণকেন্দ্র ধ্বংসের চেষ্টা শুরু হলো। আগের দিনের নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে নিতে বাড়ি ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। পরের দিনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগুন। প্রতিষ্ঠান পুড়লেও রাজনীতিবিদদের বিবেক পোড়ে না। যে রাজনীতিবিদদের বিবেক পোড়ে না, তাঁদের থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.