একটিও ভোট পড়েনি ৪২ কেন্দ্রে!

সারাদেশের অনেক ভোটকেন্দ্রে নগণ্যসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি অনেকটাই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। বিশেষ করে ৪২টি ভোটকেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এতে প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগের ভোটাররা কোথায় গেলেন? তারা কেন ভোট দিতে আসেননি?
গতকাল রোববার ভোট গ্রহণকালে দেখা গেছে, ভোটের সব আয়োজন থাকা সত্ত্বেও সারাদেশের সাতটি সংসদীয় আসনের কমপক্ষে ৪২টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এ সংখ্যা পাওয়া যায়। সংখ্যাটি আরও বাড়তে পারে। আবার একেবারে শূন্য না হলেও অনেক কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ১ থেকে ৩টি। এর মধ্যে লালমনিরহাট-৩ আসনে শূন্য ভোটের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। আসনটির ৮৯টি কেন্দ্রের ২৬টিতে একটি ভোটও পড়েনি। সদর উপজেলার বড়বাড়ী ও মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের সাতটি করে কেন্দ্র এবং কুলাঘাট ও পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নে ছয়টি করে কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এই ২৬টি কেন্দ্রের প্রায় ৪৫ হাজার ভোটারের কেউ ভোট দিতে যাননি। সহিংসতায় স্থগিত হয়ে গেছে আরও চারটি কেন্দ্র। নিজপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাই করে পুড়িয়েছে নির্বাচন বর্জনকারীরা। সিলেট-২ আসনের বিশ্বনাথ উপজেলার রামদানা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সারাদিনে একটি ভোটও পড়েনি। এ কেন্দ্রটি বিএনপির 'নিখোঁজ' সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর জন্মস্থান। এ কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ১ হাজার ৯১০টি। ভোটার উপস্থিতি কম ছিল জামায়াত-অধ্যুষিত সাতক্ষীরা-১ ও ২-এর ভোটকেন্দ্রগুলোতে। সমকাল প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী দুটি আসনে ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ দুই আসনের ২৭৭ কেন্দ্রের মধ্যে চারটি কেন্দ্র আবার ভোটশূন্য ছিল। সদর উপজেলার গোদাঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৮৫ ভোটের একটি ভোটও পড়েনি। আগরদাড়ি আমিনিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রও ছিল ভোটারশূন্য। আগরদাড়ি মহিলা মাদ্রাসা কেন্দ্রেও কোনো ভোট পড়েনি। শিয়ালডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র একটি।
জামালপুর-৪ আসনের সরিষাবাড়ী উপজেলার আরামনগর বাজার মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরসরিষাবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশুয়া বাঘমারা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বলারদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এ চারটি কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা ১১ হাজার ৪৮৬। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আজাহারুল ইসলাম সমকালকে জানান, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একজন ভোটারও ভোট দিতে আসেননি। তাই শূন্য ভোটবাক্স উপজেলা সদরে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
রাজশাহী-৬ আসনের মারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রও ছিল ভোটশূন্য। ২ হাজার ৭৯৭ ভোটারের একজনও আসেননি। কেন্দ্রে দুই প্রার্থীর পোলিং এজেন্টও ছিলেন না। বগুড়া-৭ আসনের মালিপাড়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ২ হাজার ১৫৯ ভোটারের কেউ ভোট দিতে আসেননি। একই আসনের রামচন্দ্রপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র তিনটি।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর ও পুরন্দপুর ভোটকেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। বজরাপুর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আবদুস সালাম সমকালকে জানান, ২ হাজার ৫৪২ ভোটারের কেউ ভোট দেননি। শূন্য ব্যালট বাক্স সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়া-বেড়া ইউনিয়নের দুটি ভোটকেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। রওশনিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ২ হাজার ৩৩৮ ভোটারের কেউ ভোট দেননি। ভোট পড়েনি পাশের কল্যাণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। প্রিসাইডিং অফিসার এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ফেনী-২ আসনের সোনাগাজী উপজেলার চরকান্দি ইউনিয়নের মহেশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ হাজার ৬৩২ ভোট ও মাদ্রাসা কেন্দ্রের ২ হাজার ৩৮০ ভোটারের কেউ ভোট দেননি। কক্সবাজার-৪ আসনে উখিয়ার হরিণমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ হাজার ৫৯৫ ভোটারের কেউ ভোট দেননি।
বলা হয়ে থাকে, সারাদেশের জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন গড়ে ৩৮-৪০ শতাংশের মতো। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনেও দলটির প্রতি দেশের মানুষের এমন সমর্থনই প্রতিফলিত হয়েছে। সর্বশেষ চারটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মোট ৪৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে বিপুল ম্যান্ডেট পেয়েছিল তারা। ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরে গেলেও তাদের প্রতি ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করা দলটির প্রতি ভোটারদের সমর্থন ছিল ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এ অবস্থায় গতকালের নির্বাচনে ৪২টি কেন্দ্র ভোটারশূন্য থাকায় আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক এই ভোটাররাই বা কোথায় গেলেন_ এমন প্রশ্নই সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। এ জন্য দলের অনেক নেতা নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধী দলের ব্যাপক সহিংসতার কারণে দেশজুড়ে সৃষ্ট আতঙ্কময় পরিবেশকে দায়ী করছেন। বিশেষ করে সাতক্ষীরায় জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রতিক চরম নাশকতার কারণে সেখানকার দলীয় নেতাকর্মীসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপি-অধ্যুষিত রাজশাহী, বগুড়া, ফেনীসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায়ও অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করছে। আবার ভোটকেন্দ্রে না যেতে বিরোধী দলের হুমকিও ছিল। এ কারণে এসব জেলার তুলনামূলক প্রত্যন্ত এলাকার ভোটকেন্দ্রগুলোতে কেউই ভোট দিতে যেতে পারেননি বলে মনে করা হচ্ছে। এবার জাতীয় পার্টির সঙ্গে ৪৮টি আসনে আওয়ামী লীগের সমঝোতা হওয়ায় ওই সব আসন থেকে আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থীরা সরে গেছেন। এ অবস্থায় দলীয় নেতাকর্মীরা নির্বাচন নিয়ে নিস্পৃহ অবস্থানে ছিলেন, যার প্রতিফলন হিসেবে কিছু কিছু ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়েনি। এর মধ্যে দলীয় চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে লালমনিরহাট-৩ আসনের জাপা প্রার্থী জিএম কাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলেও নির্বাচন কমিশন থেকে প্রত্যাহারপত্র গ্রহণ করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত জিএম কাদের নির্বাচনের মাঠে না থাকায় আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ছিল না। এ কারণেই আসনটির রেকর্ডসংখ্যক ২৬টি কেন্দ্রে কোনো ভোটার উপস্থিত হননি বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়া দলীয় অন্তর্কোন্দল, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে নেতাকর্মীদের প্রতি চরম অবমূল্যায়ন এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত দলীয় এমপির প্রতি অনাস্থা ইত্যাদি কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকেও অনেকে ভোটকেন্দ্রমুখো হননি।
সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের বেলকুঁচি উপজেলার ধুকুরিয়া রেড়া ইউনিয়ের দু'টি ভোট কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। রওশনিয়া দাখিল মাদরাসায় দুই হাজার ৩৩৮ ভোটারের কেউ ভোট দেননি। ভোট পড়েনি প্ট্বার্শবর্তী কল্যানপুর সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। প্রিজাইডিং অফিসার এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ফেনী-২ আসনের সোনাগাজী উপজেলার চরকান্দি ইউনিয়নের মহেশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক হাজার ৬৩২ ভোট এবং মাদরাসা কেন্দ্রের দুই হাজার ৩৮০ ভোটারের কেউ ভোট দেননি। কক্সবাজার-৪ আসনের উখিয়ার হরিনমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক হাজার ৫৯৫ ভোটারের কেউ ভোট দেননি।

No comments

Powered by Blogger.