বরিশাল খুলনা রূপগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে জাল ভোটের অভিযোগ

দেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। তবে অভিযোগ উঠেছে, ভোটার উপস্থিতি কমের সুযোগে বরিশাল, খুলনা, সিলেট, রূপগঞ্জ, যশোর, রাঙামাটিসহ বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র দখলে নিয়ে জাল ভোট দিয়েছেন সরকার সমর্থিত দলীয় নেতাকর্মীরা। জাল ভোটের অভিযোগ এনে বরিশাল-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবিনা আখতার, ৩ আসনের জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়াসহ আরও কয়েকটি আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। খবর ব্যুরো, অফিস ও প্রতিনিধিদের। বরিশাল :বরিশালে ৩টি নির্বাচনী আসনে দুই প্রার্থীর ভোট বর্জন, অধিকাংশ ভোটারের অনুপস্থিতি এবং ব্যাপক জাল ভোট প্রদানের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যে ৩টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে_ বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া), বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) ও বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ)। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট গ্রহণ করা হলেও ওই তিন আসনে কোথাও বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সবক'টি আসনের কেন্দ্রগুলোতে ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের একক আধিপত্য। কর্মী-সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখানো, এজেন্টদের বের করে দেওয়া, জাল ভোট প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে সকাল ১০টায় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন বরিশাল-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবিনা আখতার এবং বিকেল ৩টায় একই অভিযোগ তুলে বাবুগঞ্জের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন বরিশাল-৩ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপু এমপি।
ভোট বর্জনকারী স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবিনা আক্তার অভিযোগ করেছেন, বানারীপাড়া ও উজিরপুরের দুই-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা মধ্যাহ্নের পর থেকে গণহারে জাল ভোট দিয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন বানারীপাড়ায় নৌকা প্রতীকের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী পৌর মেয়র গোলাম সালেহ মঞ্জু মোল্লা। তিনি বলেন, শীতের কারণে দিনের শুরুতে ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল। তবে দুপুরের পর থেকে উপজেলার সব কেন্দ্রে বিপুলসংখ্যক ভোটার ভোট দিতে আসেন। উজিরপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ বাচ্চু সাবিনা আক্তারের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে বলেন, উজিরপুরের সবক'টি কেন্দ্রে বিশেষ করে ওটরা, জল্লা, হারতা, শোলক ইউনিয়নের ভোটাররা দলে দলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনের বিভিন্ন কেন্দ্রে একই ভোটার বারবার বিভিন্ন নামের ভোটার স্লিপ নিয়ে জাল ভোট দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বরিশাল-৪ আসনের উত্তর ভংগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি কক্ষে দেখা গেছে, ভোটারদের ব্যালট প্রদান করার পর নৌকার এজেন্ট ও কর্মীরা ওই ব্যালট নিয়ে তারাই সিল মেরে দিচ্ছেন। অন্য কেন্দ্রগুলোতেও ছিল একই অবস্থা।
খুলনা :খুলনার কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোট দিয়েছেন সরকার সমর্থক দলের নেতাকর্মীরা। দুপুর ১টার পর মহানগরীর এমএম সিটি কলেজের ৪টি, পিটিআইর ৩টি, দারুল উলুম মাদ্রাসার দুটি, ইকবালনগর বালিকা বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ব্যালট কেটে ভোট দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। কয়েকটি কেন্দ্র থেকে সহকারী প্রিসাইডিং ও
পোলিং অফিসারকে বের করে দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আদর্শ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের একজন পোলিং অফিসার অভিযোগ করে বলেন, যুবলীগের নেতাকর্মীরা নাম ও ভোটার নম্বর না মিলিয়েই জোর করে ভোট দিচ্ছেন। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মামুনুল আবেদীন বলেন, 'আপনারা যা দেখছেন, সেটাই লেখেন। আমি কিছু জানি না।' সকাল ১১টায় দৌলতপুরের শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উত্তর কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও জোর করে ভোট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নগরীর এমএম সিটি কলেজে ৪টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ও অন্য পোলিং অফিসার মিলে ভোট দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসার আনিস মাহমুদ জানান, সুষ্ঠুভাবেই ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। জাল ভোটের ছড়াছড়ির অভিযোগ ভিত্তিহীন। পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া সংক্রান্ত এক প্রার্থীর লিখিত অভিযোগ তিনি পেয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ :কেন্দ্রে কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদান, অপ্রাপ্তবয়স্কদের দিয়ে ভোট প্রদানের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্র থেকে বিপক্ষের পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া ও কেন্দ্র দখলে নিয়ে সরকারদলীয় সমর্থকরা ইচ্ছামতো ভোট দিয়েছে_ এমন অভিযোগ এনে দুপুর ১টায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শওকত আলী এবং একই ধরনের অভিযোগে বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়নাল আবেদীন নির্বাচন বর্জন করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শওকত আলী বলেন, প্রায় সব কেন্দ্র থেকেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মীরা তার পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। বিষয়টি প্রথম তিনি রিটার্নিং অফিসারকে জানান। এতে কোনো প্রতিকার না পেয়ে তিনি নির্বাচন বর্জন করেন। একই কথা বলে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়নাল আবেদীনও ভোট বর্জন করেন।
যশোর :যশোর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, কেন্দ্রগুলো আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনিরুল ইসলামের সমর্থকরা দুই উপজেলার ৩০টি কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেয়। এসব কেন্দ্রে রফিকুলের ভোটারদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয় পোলিং এজেন্টদের।
ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছেন যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা স্বপন ভট্টাচার্যও। তিনি দাবি করেন, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট টিপু সুলতানের পক্ষে অন্তত ১৫টি কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি করা হয়েছে।
যশোর-৪ (অভয়নগর-বাঘারপাড়া) আসনেও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রণজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ করেছেন এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সরকার দলীয় হুইপ শেখ আবদুল ওহাব।
লক্ষ্মীপুর :জেলার দুটি আসনে কমপক্ষে ১৬টি কেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনে স্বতন্ত্র দুই প্রার্থী নির্বাচন বয়কট করেছেন। সকাল ১১টার দিকে স্বতন্ত্র দুই প্রার্থী নির্বাচন বয়কট করেছেন। লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আজাদ উদ্দিন চৌধুরীর হরিণ প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট মো. নুরউদ্দিন সমকালকে বলেন, সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যাপক জাল ভোট প্রদান, হরিণ ও ফুটবল প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ নানা অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট একেএম শরীফ উদ্দিনও তার বয়কটের সত্যতা নিশ্চিত করে সমকালকে বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নৌকার লোকজন সন্ত্রাসী কায়দায় জিম্মি করে তার ফুটবল প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দিয়ে জাল ভোট প্রদানসহ ভোট কারচুপি করতে থাকে।
সিলেট :নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বাতিল করে ফের নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সিলেটের দুই আসনের স্বতন্ত্র দুই প্রার্থী। গতকাল নির্বাচনের ফল ঘোষণা চলাকালে নগরীর অভিজাত দুটি রেস্টুরেন্টে পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানান সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর) মুহিবুর রহমান ও সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারুক আহমদ। তারা দু'জনই নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে ভোট জালিয়াতি করে ফল ছিনিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
রাঙামাটি :রাঙামাটির ২০১টি ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী উষাতন তালুকদারের (হাতি) পক্ষ থেকে রাঙামাটি শহরের বেশকিছু ভোটকেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। উষাতন তালুকদারের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট উদয়ন ত্রিপুরা অভিযোগ করেছেন, বিকেলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের (নৌকা) সমর্থকরা রাঙামাটি শহরের কাঁঠালতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আবদুুল আলী একাডেমি, শাহ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে তারা জাল ভোট দিয়েছে।
পিরোজপুর :পিরোজপুর-৩ আসনে (মঠবাড়িয়া) কোনো কোনো কেন্দ্রে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়লেও সেখানে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নৌকার প্রার্থীর বাড়ির কেন্দ্র আন্ধারমানিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জাল ভোটের অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। জাল ভোটের অভিযোগ পাওয়া আরও কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে মঠবাড়িয়া মহিউদ্দিন মহিলা ডিগ্রি কলেজ, তুষখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ধানীসাফা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তুষখালী তোফেল আকন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.