শিকারি ও নেকড়ে এবং একটি বাঘ by অজয় দাশগুপ্ত

নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হয়েই গেল_ এমন কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে পক্ষ-বিপক্ষ দাঁড়িয়ে যাবে। এ ধরনের আরও অনেক মন্তব্যেই মুহূর্তে এক পক্ষ খুশি হবেন, আরেক পক্ষ মনোক্ষুণ্ন কিংবা এমনকি ক্ষুব্ধ হবেন। আপনি যদি বলেন, প্রায় চার কোটি ছাত্রছাত্রীকে পাঁচ বছর ধরে বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই দিতে পারা খুব ভালো কাজ। সঙ্গে সঙ্গে আরেক দল বলবে_ বইয়ের ছাপার মান মোটেই ভালো নয় এবং অনেক ভুল রয়ে গেছে। যদি আমি বলি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে_ এক দল তাতে খুশি হয়ে সাফল্যের তালিকা বাড়াতে থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে আরেক দল বলে উঠবে_ দেশে সুশাসন বলতে কিছু নেই এবং দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, শেয়ারবাজার... তালিকা বড় হতে থাকবে। রাজনৈতিক নিপীড়ন, খালেদা জিয়াকে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা_ এসবও আসবে। বাংলাদেশ আমাদের সবার অলক্ষ্যেই যেন এভাবে সবকিছুতে পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে গেছে। বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে যাদের পরিচয়, তাদের মধ্যেও এই বিভাজন। তারা টেলিভিশনের টক শোতে কিংবা বিবিসি বাংলার 'বাংলাদেশ সংলাপ' অথবা সংবাদপত্রের লেখায় নিজের 'পছন্দ-ঝোঁক' গোপন রাখতে পারেন না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে_ হয় এ পক্ষ, না হয় অন্য পক্ষ। আপনাকে কেউ নিরপেক্ষ থাকতে দেবে না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থান হলে সেটাকে স্বাভাবিক বলা যেত না। 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যা করছে নিন্দনীয়', মুক্তিযোদ্ধাদের 'খানসেনা-রাজাকার-দালাল' মারাও সমর্থন করা যায় না_ এমন 'ভালমানুষি' মন্তব্য প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে যেত। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শুধু পাশে থাকেনি, তাদের সঙ্গে গণহত্যায় অংশ নিয়েছে; তাদের বিচারের উদ্যোগে নিরপেক্ষতাও এ কারণে কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
৫ জানুয়ারি দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ তাদের মিত্র দলগুলো নির্বাচন বর্জনের আহ্বানের পাশাপাশি প্রতিহতেরও ডাক দিয়েছিল। নির্বাচনের পর ভোটার উপস্থিতি কম_ এ বিষয়টিকেই তারা বেশি করে সামনে আনবে_ সন্দেহ নেই। অন্যদিকে, সরকারপক্ষ বলবে_ বিরোধীদের নির্বাচন প্রতিহত করার আহ্বানে সাড়া মেলেনি। তারা কেবল নাশকতা-সহিংসতা সৃষ্টি করে গুটি কয়েক স্থানে ভোট গ্রহণ স্থগিত করতে পেরেছে। দুই পক্ষের এই বাগ্যুদ্ধে নাগরিক সমাজও জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কেবলই কি আলোচনা, নাকি সমাধান-সূত্রও আমাদের খুঁজে পেতে হবে? শনিবার রাজধানীতে অর্থনীতি সমিতির আলোচনায় অনেকের কণ্ঠে আহ্বান এসেছে। 'জামায়াতকে বর্জন করে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আলোচনায় বসুন।' বিএনপি কিংবা তার সমর্থকদের এটা আদৌ পছন্দ হবে না। বিএনপির জনসমর্থন যথেষ্ট_ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আন্দোলন মোকাবেলায় সরকার কঠোর মনোভাব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে আন্দোলন পরিচালনায় তারা পুরোপুরি নির্ভর করেছে জামায়াতে ইসলামীর ওপর। এ দলটি একদিকে সভা-সমাবেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক নিয়ে আসতে পেরেছে; অন্যদিকে নাশকতার কাজেও দেখাতে পেরেছে দারুণ দক্ষতা। বেশ কিছু মাদ্রাসার বিপুল জমায়েত ক্ষমতার কারণে হেফাজতে ইসলামও বিএনপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গত বছর ৬ এপ্রিল ও ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে তারা বড় ধরনের সমাবেশ ঘটাতে পেরেছিল। গত বছরে আলোচিত ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হওয়ার পর হেফাজতে ইসলাম বলতে শুরু করে, তারা এখন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি এবং ভোটের হাওয়া কোন দিকে যাবে সেটা তারা নির্ধারণ করে দিতে পারে।
কিন্তু সবকিছুর পরও এটাই বাস্তব যে, বিএনপি এবং তার মিত্ররা নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারলেও ভণ্ডুল করতে পারেনি। অপরদিকে, সরকারপক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করে নিতে পারলেও ভোটারদের মোটামুটি সংখ্যায় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেনি। এমন অবস্থায় দুই পক্ষ নিজেদের অতীত কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন কীভাবে করবে? তারা কি যা করেছি, ঠিক করেছি_ এমন অবস্থান থেকেই শুরু করবে, নাকি ভুলভ্রান্তি নির্ণয়ের চেষ্টা করবে এবং দেশের স্বার্থকে অন্য সবকিছুর ওপরে স্থান দিতে সচেষ্ট হবে? বিএনপির জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামী। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকেই বলতে থাকেন, একাত্তরের দোসররাই এ পরাজয়ের প্রধান কারণ। নির্বাচনের পর তারা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীকে তেমন কাছে টানেনি। কিন্তু হঠাৎ সামনে চলে এলো জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররাই কেবল করতে পারে_ এমন আস্থা দেশবাসী, বিশেষ করে তরুণ বয়সীরা পর্যন্ত করেছে এবং সেটা যথার্থভাবেই। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে অনেকে মনে করেছে জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপি থেকে দূরে সরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগের আপসের কৌশল হিসেবে। শাহবাগে ওই সন্ধ্যায় যে কয়েকশ' তরুণ সমবেত হয়েছিল, সেটা এই ধারণা থেকেই। এর পরের দুই সপ্তাহ সারাদেশে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বেশির ভাগ সংবাদপত্র ও টেলিভিশন যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পক্ষ নেয়। জামায়াতে ইসলামী মরিয়া হয়ে ওঠে অস্তিত্বের শঙ্কা থেকে। বিএনপি পড়ে যায় উভয় সংকটে। তারা প্রথমে বলে, তরুণদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকারের ব্যর্থতার দাবিও তুলতে হবে। এ অবস্থান ছিল যৌক্তিক। কিন্তু হঠাৎ বেগম খালেদা জিয়া তরুণ প্রজন্মের এ আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের 'নাস্তিক' আখ্যায়িত করলেন। বিএনপি সমর্থক পত্রিকা 'আমার দেশ' এবং জামায়াতে ইসলামীর দিগন্ত টেলিভিশন 'নাস্তিক' ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসে এবং কুৎসা রটনার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তাদের পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। তাদের ৫ মে শাপলা চত্বরের সমাবেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বেগম খালেদা জিয়া তার দলের নেতাকর্মী এবং ঢাকাবাসীদের প্রতি আবেদন জানান। এতে বিন্দুমাত্র সাড়া মেলেনি। কিন্তু ওই রাতে সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার কঠোর পদক্ষেপকে ইস্যু করে বিএনপি এবং তাদের ধর্মান্ধ সহযোগীরা ফের অপপ্রচারে নামে এবং তাতে আপাতভাবে সফলও হয়। আওয়ামী লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। বিএনপি এই ধর্মান্ধ শক্তির উত্থানকে পুঁজি করেই আন্দোলন সফল এবং নির্বাচন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করে।
মাত্র ৫ বছর আগেই তরুণ প্রজন্ম দলে দলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটিকে মুখ্য করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে। এ প্রজন্মই ছিল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রধান শক্তি। এরা তো বাংলাদেশের সমাজেরই অংশ এবং তাদের শক্তিকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। আওয়ামী লীগ যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে যে কোনো বাধা মোকাবেলার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে পেরেছে, তার পেছনে কাজ করেছে এই শক্তির সমর্থন। এই তরুণদের জামায়াতে ইসলামীর মতো অর্থবিত্ত নেই। মাদ্রাসা থেকে যেমন 'বড় হুজুর-ছোট হুজুরদের' কথায় দলে দলে ছাত্ররা বের হয়ে এসে সমাবেশকে বড় করে তোলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। শাহবাগসহ দেশের সর্বত্র তাদের জমায়েত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সমাজের অভ্যন্তরে অবস্থান করা এ শক্তিকে উপেক্ষা করলে বিএনপি আবারও ভুল করবে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জনগণ যে শক্তিকে 'অপশক্তি' হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের ওপর কেন বেগম খালেদা জিয়া এতটাই নির্ভর করতে গেলেন_ সে মূল্যায়ন এখন তাদের করতেই হবে। এ শক্তির অর্থবিত্তের এত দাপট কীভাবে, সেটাও কিন্তু আলোচনায় আসতে হবে। নাশকতা পরিচালনায় সাংগঠনিক শক্তি যেমন অপরিহার্য, তেমনি চাই অর্থের জোর। জামায়াতে ইসলামী সেটা দেখাতে পেরেছে। ১৯৭১ সালের প্রত্যক্ষদর্শীরা এখন বলতে পারেন_ এটাই গোলাম আযম-মতিউর রহমান নিজামীর আসল চেহারা। বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাদের কর্মকাণ্ড দেখে স্পষ্ট ধারণা পেল_ জামায়াতে ইসলামী কী ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক একটি রাজনৈতিক শক্তি! বিএনপিকে তাদের এভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এবং আন্দোলন ও নির্বাচনে তাদের ওপর এ নির্ভরতার অবসান ঘটাতেই হবে।
তবে এ কাজটি মোটেই সহজ নয়। বিএনপি তাদের স্ট্রাইক ফোর্সকে হারাতে চাইবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনসমর্থন মোটামুটি সমানে সমান। জামায়াতে ইসলামীর ভোট তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও কর্মী বাহিনী উল্লেখযোগ্য এবং আর্থিক ক্ষমতা বিপুল। আর যেখানে সহিংসতার প্রয়োজন, সেখানে এ শক্তি যথেষ্ট কার্যকর। এখন বিএনপি কী করবে?
আওয়ামী লীগের আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন পড়বে অনেক বেশি। তারা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় অনেক সফল। অর্থনীতির অঙ্গনে তাদের পারফর্ম্যান্স যে কোনো সরকারের জন্য ঈর্ষণীয় হতে পারে। হায়! তারা যদি পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারত! তারা যদি শেয়ারবাজারের 'দুষ্টুদের' শায়েস্তা করতে পারত!
তারা 'সুশীল সমাজের' অনেককে অপছন্দ করছে এবং সেটা বলছে প্রকাশ্যে। এ বিচ্ছিন্নতা কীভাবে কাটাবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সমাজেও তাদের বিস্তর কাজ করার রয়েছে। তারা এই দুই অঙ্গনে যথেষ্ট বিচ্ছিন্ন হয়েছে_ এটাই নিষ্ঠুর বাস্তব। যুক্তরাষ্ট্রে সেই ১৯৭১ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের বিরোধী এবং বিএনপি তাদের অপেক্ষাকৃত পছন্দের দল। জামায়াতে ইসলামীকেও তারা গ্রহণ করে নিতে আগ্রহী। যে দলটি এত সহিংস রাজনীতি করছে, তাদের নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে রাখা হলে আরও হিংসার পথে চলবে_ এটা বলে তারা কি ব্ল্যাকমেইল করতে চায়_ এ প্রশ্ন যৌক্তিক মনে হতে পারে। শেখ হাসিনা 'চমকের মন্ত্রিসভা' (অনেকের কাছে কচিকাঁচার দল) দিয়েও এত সফলতা পেয়েছেন বলে আত্মতৃপ্ত থাকার লোকও মিলবে অনেক। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উঠবে এবারের নির্বাচনের প্রশ্ন। দেশ-বিদেশে সবাই বলবে_ এটা আদৌ গ্রহণযোগ্য হয়নি। অতএব, তাগিদ আসবে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের, যেখানে সব দল অংশগ্রহণ করবে। আওয়ামী লীগের অতিউৎসাহী কোনো কোনো নেতা বলছেন, 'পাঁচ বছরের আগে নির্বাচন নয়।' এসব বাহুল্য কথা। দলকে আরও বিব্রত করার কথা। আওয়ামী লীগকে দেশ-বিদেশের বিচ্ছিন্নতা কাটাতে হলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পথে যেতে হবে।
দুটি দলকে একটি মৌলিক প্রশ্নেও সমঝোতায় আসতে হবে_ নির্বাচনকালীন সরকার। কেবল ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনেই কোনো সমস্যা হয়নি। সেবার আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে বিচারপতি লতিফুর রহমানের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল। অন্যথায় গত প্রায় দুই দশকে প্রতিটি নির্বাচনেই এ সরকার নিয়ে ফ্যাসাদ হয়েছে। নতুন একটি নির্বাচন দ্রুত হোক_ সেটা প্রায় সবাই বলছেন। কিন্তু তার আগে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে অবশ্যই ফয়সালা হতে হবে এবং সেটা হতে হবে অনেক বছরের জন্য। কিংবা আরও ভালোভাবে বলতে পারি, এটা হতে হবে 'সব সময়ের' জন্য। এ সময়ে বিএনপি এবং তার মিত্ররা সরকারের ওপর চাপ রাখার জন্য কী ধরনের রাজনৈতিক কৌশল নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। তাদের হরতাল-অবরোধের রাজনীতি এতদিন জনগণকে উৎসাহিত করতে পারেনি। নির্বাচনের পরপরই পারবে_ সেটাও মনে হয় না। তাদের আন্দোলনের যে কোনো কর্মসূচি এখন 'শিথিল ও ঢিলেঢালা' হতে বাধ্য। এর পরিবর্তে তারা যদি গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে দেশবাসীর কাছে বক্তব্য রাখতে থাকে, সেটা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মধ্যে যারা ১৯৭১ সালে সরাসরি হত্যা-লুণ্ঠন ও অন্যান্য ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল, তাদের বিচার প্রশ্নেও চাই সমঝোতা। বিএনপির জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর ইস্যু ছিল_ ক্ষমতায় এলে কি বিচার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে? গোলাম আযম-নিজামীদের কি ছেড়ে দিয়ে ফের মন্ত্রী বানানো হবে? তবে আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্রদের এটাও মনে রাখা চাই যে, জামায়াত-হেফাজত সমাজেই রয়েছে এবং তাদের হীনবল করার জন্য দমন-পীড়ন কৌশল খুব একটা কার্যকর নয়। এজন্য বেশি প্রয়োজন সমাজের অভ্যন্তরে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া এবং শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ধরনের কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ প্রদান। সব সময় এ সংগ্রাম রাজপথে হবে না। এজন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেতে হবে, কারখানায় শ্রমিকদের মধ্যে যেতে হবে। কৃষক-দিনমজুরদের কাছে যেতে হবে। গত পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে এ কাজটি নিতান্তই গৌণ হয়ে পড়েছিল। তারা মনোযোগী ছিল সরকারি কাজের ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি ও দখলের কাজে। আগামী পাঁচ বছর বা তার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত তারা 'নির্বিঘ্নে' দেশ পরিচালনা করে যাবে_ সে ভাবনাতে মশগুল হয়ে থাকলে তার চেয়ে বড় ভুল আর কিছু হবে না। অতি সহজে যারা সংসদ সদস্য হয়েছেন, তারা 'যত দ্রুত পারি কামিয়ে নিই'_ এ মনোভাব নিয়ে থাকলে সেটাও হবে শেখ হাসিনার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিএনপি নির্বাচন ভণ্ডুল করতে পারেনি। এখন তারা 'অবৈধ' সরকার বাতিলের আন্দোলনে যাবে। কিন্তু কৌশল কি সেই হরতাল-অবরোধ এবং নাশকতা-হিংসাত্মক উন্মত্ততা প্রদর্শন? এ থেকে তারা সরে না এলে দেশের পরিণতি আরও খারাপ হবে। আওয়ামী লীগ সমঝোতা-সূত্র খুঁজতে উৎসাহ না দেখালে এবং দমন-পীড়ন কৌশল অনুসরণ করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করলে নিজেদের বিচ্ছিন্নতাই শুধু বাড়াবে না, আরও বিপর্যয়ের জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
উপসংহারে আমরা সেই গল্পের কথা স্মরণ করতে পারি। এক নেকড়ে ও এক শিকারি লড়েছে হাতাহাতি, প্রাণপণে। দু'জনেই ক্লান্ত-বিপর্যস্ত। এক পর্যায়ে এমন শক্তিহীন তারা যে, কেউ কাউকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার মতো আঘাতটি করতে পারছে না। এ সময়ে এক বাঘ এগিয়ে এলো এবং শিকারি ও নেকড়ে উভয়কেই বিনা বাধায় তার ডেরায় টেনে নিয়ে গেল নিশ্চিন্তে আহারের জন্য।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিশ্চয়ই এমনটি চাইবে না।
ajoydg@gmail.com
সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.