দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার পথে বাংলাদেশ

জামায়াতের সহিংসতা ও বিএনপির বর্জনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হলেও দৃশ্যত দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পথেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তাজা খবরের পাশাপাশি একাধিক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে এ রকম মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। বিরোধী দলের বর্জনের মুখে জৌলুসহীন অনেকটা নিয়মরক্ষার নির্বাচন হলেও এ নিয়ে দিনভর সরব ছিল বিশ্ব মিডিয়া। বিবিসি, আলজাজিরা, সিএনএনসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সহিংসতার মধ্যে ভোট গ্রহণের খবরের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে নানা বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন। সময়ে সময়ে হালনাগাদ (আপডেট) সংবাদ প্রকাশ করে সক্রিয় ছিল বিশ্বখ্যাত টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন ভার্সনও। বিকেল সাড়ে ৪টায় টাইমস অব ইন্ডিয়ার সর্বশেষ আপডেট সংবাদ 'বাংলাদেশের নির্বাচনে সহিংসতায়
নিহত ১২ :ভোটার উপস্থিতি কম'। একই সঙ্গে 'বাংলাদেশ অ্যাপিয়ার্স হেডেড ফর পলিটিক্যাল ইনসটেবিলিটি' শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদনও ছিল টাইমস ইন্ডিয়া অনলাইনে। ইন্দ্রানী বাগচির লেখা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বিএনপির বর্জন এবং
জামায়াতের সহিংসতার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নির্বাচন করছেন। কিন্তু দৃশ্যত, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে একটা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে।
এতে আরও বলা হয়, ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন নির্বাচিত হওয়ায় এ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভোটের দিনও বিরোধীদলীয় নেতারা নিরাপত্তা হেফাজতে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের যে কোনো অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য হতে পারে দুঃসংবাদ। বাংলাদেশ থেকে যে নিরাপত্তাজনিত হুমকি ভারতের প্রতি ছিল, তা মোকাবেলায় ভারত গত পাঁচ বছর হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে। বিএনপি-জামায়াত সরকার হলে সম্ভবত ভারতের দুশ্চিন্তা ততটা সহানুভূতি পাবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা এখন বিতর্কের বিষয় যে, অস্থিতিশীল বাংলাদেশ ভারতের জন্য ভালো হবে কি-না।
সময়ের ব্যবধানে নির্বাচনের আপডেট নিউজ প্রকাশের পাশাপাশি বার্তা সংস্থা এএফপির বিশ্লেষণ :'আনরেস্ট থ্রেটেন বাংলাদেশ হার্ড ওন প্রগ্রেস' বা অস্থিতিশীলতায় হুমকির মুখে বাংলাদেশের কষ্টার্জিত অগ্রগতি। এতে বলা হয়, নির্বাচনের পরও বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে ব্যাহত হতে পারে দেশটির সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি। এশিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর অন্যতম হলেও গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। এ সময়ে দারিদ্র্য কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। একসময়ের তলাহীন ঝুড়ি বাংলাদেশের পরিচয় এখন এশিয়ার উদীয়মান বাঘ বা ইমার্জিং টাইগার হিসেবে। কিন্তু এখন বিরোধী দলের বর্জনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
'পোলিং স্টেশন অ্যান্ড পুলিশ অ্যাটাকড অ্যাজ বাংলাদেশ ভোটস' শিরোনামে নির্বাচনের আপডেট এক খবরে এএফপির মন্তব্য, 'এই নির্বাচন সহিংসতাকে আরও উস্কে দিতে পারে_ গত বছরজুড়েই যে সহিংসতা অব্যাহত ছিল'। পাকিস্তানের 'ডন'সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপির এই সংবাদ হুবহু প্রকাশ করেছে।
'ভায়োলেন্স মারস কন্ট্রোভার্সিয়াল বাংলাদেশ পোলস' শিরোনামে আলজাজিরা অনলাইনের বিশ্লেষণ :নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। ভোটের পর আরও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রধান দুই দলের দ্বন্দ্ব এই আশঙ্কার পাশাপাশি একটা অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হতে পারে বলেও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, গত কয়েক মাসে আমরা যে অচলাবস্থা দেখছি এ নির্বাচন কোনোভাবেই তার সুরাহা করবে না। 'ক্ল্ল্যাসেজ অ্যান্ড বয়কট মারড বাংলাদেশ ইলেকশন' শিরোনামে ভোটের খবর প্রকাশ করে বিবিসি অনলাইন। বিবিসি বাংলার সম্পাদক সাবির মুস্তাফা বলেন, (আজ) ৬ জানুয়ারি সকালে এটা বড় প্রশ্ন হবে না যে ভোটে কে জিতেছে, বরং বড় প্রশ্ন হবে এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে? বিবিসির মাহফুজ সিদ্দিক তার বিশ্লেষণে বলেন, নির্বাচনের পর শাসক দলের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে দেশ-বিদেশে আইনগত বৈধতার বিষয়টি। আর রাজনৈতিক সংকট থেকে যাবে সেই তিমিরেই। একমাত্র স্বস্তির কারণ হতে পারে প্রধান দুই দলের সম্ভাব্য সংলাপ।
'বাংলাদেশ ইলেকশন মারড বাই অপজিশন বয়কট, ভায়োলেন্স' শিরোনামে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, দুই প্রধান দলের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের কোনো ইঙ্গিত নেই। ফলে প্রশ্নের মুখে নির্বাচনের আইনগত বৈধতা। আর আশঙ্কা রয়েছে আরও সহিংসতা ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হওয়ার। 'বাংলাদেশ ভোটস অ্যামিড ভায়োলেন্স, অপজিশন বয়কট' শিরোনামে সিএনএনের বিশ্লেষণ : নির্বাচনী অস্থিতিশীলতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির মৌলিক সমস্যাটাই সামনে নিয়ে এসেছে। এমনিতেই যে দেশটি মোকাবেলা করছে দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ। ভারতের ডিজিটাল নিউজ এজেন্সি ডিএনএর বিশ্লেষণ : 'বাংলাদেশ ইলেকশনস : আওয়ামী লীগ উইনস ডেমোক্রেসি লসেজ'। অর্থাৎ বাংলাদেশের এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলেও পরাজয় ঘটবে গণতন্ত্রের। 'বাংলাদেশ ইলেকশনস : ১২ কিলড, ২০০ পোলিং স্টেশনস সেট অ্যাবলেজ ইন ভায়োলেন্স' শিরোনামে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, নির্বাচনের পর ক্ষমতায় ফিরে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সমস্যাটা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমাদেশ এ নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নয়াদিলি্লতে এখন যে আশঙ্কাটা কাজ করছে তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো অনেক দেশ শেখ হাসিনা সরকারকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। যার অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশটির ওপর। ১৯৯৬ সালে এমনটা হয়েছিল খালেদা জিয়া সরকারের। কিন্তু ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সেই সরকারের পতন হয়েছিল। 'ফাইট ফর বাংলাদেশ : কান্ট্রি সিকস টু রিটেইন ইটস আইডেনটিটি অ্যামিড গ্রোয়িং ইসলামিক ইনফ্লুয়েন্স' (বাংলাদেশের জন্য লড়াই : ইসলামী প্রভাব বৃদ্ধির মধ্যে নিজের আসল পরিচয় বহাল রাখতে চাচ্ছে দেশটি) শিরোনামে আরেকটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, এই নির্বাচনে শুধু দুর্নীতি, অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলার মতো সাধারণ বিষয়গুলোই ইস্যু নয়। বরং বাংলাদেশের মূল চেতনাটাই এখানে মূল ইস্যু। বাংলাদেশ কি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক না ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

No comments

Powered by Blogger.