নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলিম নারীদের অসম্মান by রিজিয়া আহমদ

প্রধানমন্ত্রী শুধু নন, বিরোধী দলের নেত্রী থেকে সর্বশেষ নির্বাচিত স্পিকার পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদগুলোতে নারীরা থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিশেষ করে মুসলিম নারীরা যে মোটেও নিরাপদ নন, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় নিয়মিতভাবে।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, দীপু মনি, সাহারা খাতুন, মন্নুজান সুফিয়ান ও মেহের আফরোজ চুমকির মতো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং অন্য ক্ষমতাসীনদের কথাও উল্লেখ করা দরকার। কারণ তারা নারী তো বটেই, পাশাপাশি মুসলমানও। সুতরাং এমন আশা করা যেতেই পারে যে, এতজন নারী যেদেশের সর্বোচ্চ পদগুলোতে রয়েছেন সেদেশে অন্তত নারীদের অসম্মান ঘটবে না। অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা কিন্তু ক্ষুব্ধ করে তোলার মতো। এ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ২২ মে। সেদিন রাজধানীর উদয়ন হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে কথিত ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগে প্রায় ৫০ জন ছাত্রীর স্কুল ড্রেসের হাতা কেটে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রিন্সিপাল। তারা কিশোরী নয়, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। অভিযোগের কারণ, ওই ছাত্রীদের পরনে স্কুল ও কলেজের ড্রেস ঠিকই ছিল; কিন্তু ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে তারা হাফ হাতার পরিবর্তে ফুল হাতা জামা পরেছিল। এতেই নাকি ‘শৃঙ্খলা’ ভঙ্গ করে ফেলেছিল ওই ছাত্রীরা! আর সে কারণে কৈফিয়ত দেয়ার বা আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনোরকম সুযোগ না দিয়েই ভাইস প্রিন্সিপাল সোজা কাঁচি হাতে অপারেশন চালিয়েছেন। নিজেই ছাত্রীদের জামার হাতা কেটে ফেলেছেন। এই কাঁচি অপারেশনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন অভিভাবকরা। ওদিকে সবার সামনে লজ্জা দেয়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েছিল ছাত্রীরা। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদের (১)-এর ক ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। তাছাড়া ওই অনুচ্ছেদের খ ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।’ অন্যদিকে উদয়ন স্কুল কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে তার ভাইস প্রিন্সিপাল দেশের সংবিধানের নির্দেশনাকেও উপেক্ষা ও লঙ্ঘন করেছেন। স্মরণ করা দরকার, সংবিধানের কোথাও কিন্তু বলা হয়নি যে, হিজাবসহ পর্দা করার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিতে হবে, না নিলে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। আর সে অপরাধের দণ্ড দেবেন কোনো স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল নিজেই।
ধারণা করা হয়েছিল, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদের ঝড় যেমন উঠবে তেমনি কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে ওই ভাইস প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধেও। কিন্তু এদিক-সেদিক থেকে দু-একটি বিবৃতিই শুধু এসেছে, প্রতিবাদী কোনো আন্দোলনের খবর পাওয়া যায়নি। এর কারণ, প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, আলোচ্য ভাইস প্রিন্সিপাল যেনতেন ব্যক্তি নন, তিনি একজন মন্ত্রীর স্ত্রী। সুতরাং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা অন্তত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কল্পনা করা যায় না। শুনতে বিস্ময়কর মনে হতে পারে; কিন্তু পাঠকরা ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলের বিরুদ্ধে চালানো নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের অভিযান থেকে সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চালানো গণহত্যার কথা স্মরণ করতে পারেন। দেখবেন, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমন-নির্যাতনের পাশাপাশি ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার কারণেও সরকার প্রথম থেকে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। মনে হচ্ছে, মুসলমানবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার অঙ্গীকার করেই সম্ভবত ক্ষমতায় এসেছে সরকার। উদাহরণ দেয়ার জন্য অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ঘটনাটি গত বছরের ১৭ ডিসেম্বরের। সেদিন সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার ২১ জন সদস্য ও নেত্রীকে গ্রেফতার করেছিল। তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর বন্দি নেতা আবদুল কাদের মোল্লার স্ত্রী সোনোয়ারা হোসেন ছিলেন, ছিলেন একজন সন্তানসম্ভবা নারীও। পুলিশ জানিয়েছে, এই মুসলিম নারীদের ‘অপরাধ’, তারা নাকি সরকারের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ করার উদ্দেশ্যে ‘গোপন’ বৈঠক করছিলেন! কথিত ‘গোপন’ বৈঠক যেখানে হচ্ছিল সেখানে নাকি বিপুল পরিমাণ ‘জঙ্গি’ ও ‘জিহাদি’ বই-পুস্তক পাওয়া গেছে! নমুনা হিসেবে টিভিতে কিছু বই-পুস্তকের প্রচ্ছদ দেখানোর আয়োজনও করেছে সরকার। বোরকা ও হিজাব পরা এই ২১ মুসলিম নারীকে সারা রাত থানা হাজতে রাখা হয়েছিল। পরদিন জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশ তাদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেছিল। বিস্ময়কর হলেও সহজবোধ্য কারণে বিচারকও দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। রিমান্ডে নেয়ার পর শুরু হয়েছিল নতুন পর্যায়ের নির্যাতন। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, পুলিশ তাদের ছোট একটি কক্ষে গাদাগাদি করে রেখেছিল। ২১ জন একটিমাত্র ওয়াশরুম ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন। সারাদিনে একবার মাত্র ভাত পেয়েছেন তারা। বাকি দুই বেলা দেয়া হয়েছে শুধু পাউরুটি। প্রচণ্ড শীতের রাতেও সবাইকে লেপ বা কম্বল দেয়া হয়নি। ২১ জনের জন্য কম্বল এসেছিল মাত্র চারটি। ওদিকে জিজ্ঞাসাবাদের নামেও চালানো হয়েছিল চরম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। পুলিশ নাকি দায়িত্ব পালনের ব্যস্ততার কারণে দিনের বেলায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় পায়নি! সে কারণে বন্দি মুসলিম নারীদের পালাক্রমে রাতের বেলায় ওসি’র কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নেয়াও হয়েছিল একজন-একজন করে। লোকদেখানোর জন্য একজন নারী পুলিশকে উপস্থিত রাখা হলেও কথা যা বলার সবই বলেছিল পুলিশের পুরুষ সদস্যরা। দুর্ব্যবহারও করেছে তারা যথেচ্ছভাবে। প্রত্যেক নারীকে জোর করে হিজাব ও মুখের নেকাব খুলিয়ে ছেড়েছিল পুলিশ। বন্দি নারীদের চুল ধরেও টানাটানি করেছে তারা। চেষ্টা করেছে জোর করে তাদের ইচ্ছামত স্বীকারোক্তি তথা জবানবন্দি আদায় করার জন্য। অন্যদিকে মুসলিম ২১ নারীকে গ্রেফতার এবং তাদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠন। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলিম নারীদের গ্রেফতার করার এবং পাশাপাশি তাদের সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোটাই অবশ্য স্বাভাবিক।
আমরা মনে করি, বিষয়টিকে কোনোক্রমেই হালকাভাবে নেয়া যায় না। কারণ ইসলামী ছাত্রী সংস্থা কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয় যে, তার সদস্য বা নেত্রী ও কর্মীরা কোনো সভা বা বৈঠক করতে পারবেন না। তাছাড়া যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের ছাত্রী। তাদের প্রত্যেকেই সামাজিক দিক থেকে মর্যাদাসম্পন্ন। এ ধরনের কোনো একজনকেই অসম্মানিত করার আইনগত অধিকার নেই পুলিশ বা সরকারের। রাজনৈতিক কারণে ভিন্নমত পোষণ করার সাংবিধাানিক অধিকারও তাদের রয়েছে। সুতরাং তারা সভা বা বৈঠক করতেই পারেন। কিন্তু অমন একটি স্বাভাবিক সাংগঠনিক বৈঠককেও পুলিশ ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে প্রচার করেছে। বড়কথা, পবিত্র আল-কোরআন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস এবং সাহাবা (রা.)-দের জীবনীসহ যেসব বই-পুস্তক দেখানো হয়েছে, সে ধরনের বই-পুস্তক বাংলাদেশের সব মুসলিম পরিবারেই কম-বেশি রয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের বাসা-বাড়িতে গেলেও এসব বই-পুস্তক পাওয়া যাবে। সুতরাং কোনো মুসলিম নেত্রীর বাসায় বা ইসলামী ছাত্রী সংস্থার অফিসে বই-পুস্তকগুলো থাকলে তার মধ্যে দোষ বা অপরাধের কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু সে বিষয়টিকেই সরকার পুলিশ ও টিভি চ্যানেলগুলোকে দিয়ে এমনভাবে হাজির ও প্রচার করিয়েছে, যা দেখে ও শুনে মনে হয়েছে যেন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার ওই সদস্যরা একটি ঘরের মধ্যে বসে জিহাদ ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ট্রেনিং নিচ্ছিলেন! যেন সত্যি তারা কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ করছিলেন! অত্যন্ত আপত্তিজনক অমন এক অভিযোগে পুলিশ তাদের শুধু গ্রেফতার করেনি, থানা হাজতে নিয়ে নির্যাতন ও অসম্মানও করেছে। রিমান্ডের অনুমতিও মানুষমাত্রকেই স্তম্ভিত করেছে। কারণ সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছিল না ওই ২১ জনর বিরুদ্ধে। পুলিশ কোনো মামলাও দায়ের করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেবলই পুলিশের আবেদন শুনেই ত্বরিত মঞ্জুর করা হয়েছে রিমান্ড। সেটাও আবার দু’দিনের জন্য!
এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, রিমান্ডের ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কয়েকটি অবশ্যপালনীয় নির্দেশনা রয়েছে। প্রথমত পুলিশ চাইলেই রিমান্ড মঞ্জুর করা যাবে না। মঞ্জুর করার আগে বিচারককে মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করতে হবে এবং বুঝতে হবে, এ ধরনের মামলায় রিমান্ডের আদৌ দরকার ও যৌক্তিকতা রয়েছে কি-না। দ্বিতীয় নির্দেশনা হলো, মঞ্জুর করা হলেও রিমান্ডে থাকাকালে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় অভিযুক্ত বা আসামির আইনজীবীকে উপস্থিত রাখতে হবে এবং এমন কোনো স্বচ্ছ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, যাতে স্বজনসহ অন্যরা বাইরে থেকে সবকিছু দেখতে পারেন। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো এবং জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়কেও নিষিদ্ধ করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। অন্যদিকে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সদস্যদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের কোনো নির্দেশনাই মানা হয়নি। বাস্তবে এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি বরং ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা ও অসম্মানই দেখানো হয়েছে। বর্তমান পর্যায়েও উদয়ন হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে একই ধরনের অপরাধ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

No comments

Powered by Blogger.