নদীর তিন কিলোমিটারে আটটি বাঁধ দিয়ে রাস্তা by উজ্জ্বল মেহেদী ও জুয়েল খান

নদীর তীরের তিন কিলোমিটার অংশে ১২টি গ্রাম। গ্রামবাসীর পারাপারের জন্য রয়েছে দুটি সেতু; সরকারিভাবে নির্মাণাধীন আছে আরেকটি। তিন সেতু থাকার পরও নদীর তীরের বাসিন্দারা নিজেদের যাতায়াত-সুবিধায় আটটি বাঁধ দিয়ে তৈরি করেছেন নদী পারাপারের জন্য নিজস্ব রাস্তা।
মাত্র তিন কিলোমিটারজুড়ে পারাপার-বিলাসে নদীর সর্বনাশের এ চিত্র সিলেটের কুশিয়ারার এক শাখা নদীর।
নদীর নাম রত্না; এর দৈর্ঘ্য প্রায় চার কিলোমিটার। গত মার্চ থেকে নদীটির বুকে একে একে আটটি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে ফেঞ্চুগঞ্জসহ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায় বিস্তৃত দামড়ির হাওর বর্ষার শুরুতেই জলাবদ্ধতার মুখে পড়েছে। কারণ, দামড়ির হাওরের পানি প্রবাহিত হয় ডালার নদ হয়ে রত্না নদী দিয়ে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চন্দন কুমার মহাপাত্র জানান, এ অবস্থায় হাওরের প্রায় আড়াই হাজার একর বোরো ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
নদী আইন অনুযায়ী নদীশাসন আইনত অপরাধ—এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম বলেন, ‘নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতেই সরকারি উদ্যোগে সেতু হচ্ছে। কিন্তু যে নদী রক্ষায় সরকারি টাকা খরচ করে সেতু হচ্ছে, বাঁধ দিয়ে রাস্তা করে সেই নদীই যদি মেরে ফেলা হয়, তাহলে সেতু করে আর কী লাভ!’
সরেজমিনে দেখা গেছে, রত্নার তিন কিলোমিটার অংশের উভয় তীরে কটালপুর, আটঘর, দীনপুর, ইলাশপুর, মুহিতপুর, ছালেহপুর, কোনাপাড়া উত্তর ও দক্ষিণ, পূর্বপাড়া, সোনাপুর এবং খিলপাড়া উত্তর ও দক্ষিণ গ্রাম। গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নির্মিত দুটি পুরোনো সেতু রয়েছে। যাতায়াত-সুবিধা বাড়াতে এলজিইডির অর্থায়নে আরেকটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।
এলজিইডির ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মো. জিহান আল তুহিন জানান, ৩২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ১৩৫ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ১০ মার্চ থেকে নির্মাণকাজ শুরু হয়।
নতুন সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যে দীনপুর গ্রাম থেকে নদীতে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করা শুরু হয়। সেতু থাকার পরও বাঁধ দেওয়ার পেছনে নদী দখলই মূল উদ্দেশ্য বলে গ্রামবাসীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন।
১২ গ্রামের মধ্যে যে তিন গ্রামের (আটঘর, দীনপুর, পূর্বপাড়া) মানুষের চলাচলের সুবিধায় সেতু রয়েছে, ওই গ্রামগুলোর মুখেও বাঁধ দেওয়া হয়েছে। আটঘর এলাকায় দ্বিতীয় রাস্তাটি করেছেন আছার আলী, পাখি মিয়া, ওয়ারিছ আলী, আবদুর রহমান। দীনপুরে আয়াজ মিয়া; উত্তর খিলপাড়া এলাকায় পাশাপাশি দুটি বাঁধ দিয়ে রাস্তা করেছেন পংকি মিয়া, ছালিক মিয়া, বুরহান উদ্দিন ও চেরাগ আলী। সাবেক ইউপি সদস্য লুলু মিয়া ও ছাখন মিয়া দুটি বাঁধ দিয়ে রাস্তা করেছেন দক্ষিণ খিলপাড়ায়।
প্রতিটি বাঁধ ১৩০ থেকে ১৮০ ফুট দীর্ঘ এবং ৪০ থেকে ৫০ ফুট উঁচু। কোনো কোনো বাঁধে চলাচলের সুবিধায় ইট ও পাথর ফেলে স্থায়ী রাস্তার রূপ দিতে দেখা গেছে। রাস্তা টেকসই করতে কালভার্টও দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে এলাকাবাসীর ‘স্বার্থে’ অস্থায়ীভাবে রাস্তা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তাঁরা সবাই। বুরহান উদ্দিন বলেন, ‘নদী দিয়ে বর্ষায়ও এখন আর নৌকা চলে না। এ জন্য রাস্তা করা হয়েছে।’
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহামঞ্চদ আনোয়ার হোসেন জানান, নদীতে বাঁধ দিয়ে এভাবে রাস্তা করার কোনো বৈধতা নেই। নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে রাস্তা তৈরি নদী আইন অনুযায়ী অবৈধ। প্রশাসনও এ ক্ষেত্রে কোনো অনুমতি দেয়নি। বিষয়টি সরেজমিনে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.