অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সিপিডির পর্যালোচনা অর্থনীতির উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে গেছে

বর্তমান সরকারের প্রথম তিন বছরে অর্থনীতিতে যেসব উদ্যোগ, উদ্দীপনা ও প্রবৃদ্ধির গতি ছিল, শেষ ১৮ মাসে তা স্তিমিত হয়ে গেছে। যদিও নিম্নপর্যায়ের স্তিমিত অর্থনীতির মধ্যেও একধরনের ভারসাম্য বজায় রয়েছে। তবে তা চাহিদা ও সম্ভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
এভাবেই সরকারের সাড়ে চার বছরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূল্যায়ন করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ‘দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল সোমবার বিকেলে সংস্থাটির ধানমন্ডি কার্যালয়ে এই মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ সময় বলেন, ‘সাড়ে চার বছরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারের ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে ছিল ৬ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, সরকারি ব্যয় ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, কৃষিতে ঋণ ও উপকরণ বিতরণে সাফল্য, অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের সহজপ্রাপ্যতা। আর এর বিপরীতে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সমস্যা, পুঁজিবাজারে ধস, হল-মার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির মতো ঘটনা, পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, সরকারি বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, নানা বিতর্কের মধ্যে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, উন্নয়ন-সহযোগীদের সঙ্গে সভা বন্ধ, ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট আলোচনা হলে মাশুল ঠিক করতে না পারা, টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর বিতর্কের মতো নেতিবাচক নানা ঘটনা অবলোকন করেছি।’
এই বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রী ৬ জুন যে বাজেট দিতে যাচ্ছেন, তাতে রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা খুব বেশি স্থান পাবে বলে মনে করেন না দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থার গবেষণা বিভাগের প্রধান ফাহমিদা খাতুন, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে চলতি অর্থবছরের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আগামী অর্থবছরে অর্থনীতির খাতভিত্তিক চ্যালেঞ্জ ও পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, চলতি বছর শেষে দেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না। মূলত জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে কৃষি খাতের অবদান গত বছরের চেয়ে কমে যাওয়ায় এ বছর কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে না। তাই আগামী বাজেটে বাস্তবতার নিরিখে প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করতে হবে। যদি উচ্চাভিলাষী প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে শেষ পর্যন্ত সেটি অর্জন করা সম্ভব না হয়, তাতে অর্থনীতির শৃঙ্খলা ব্যাহত হবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতু তৈরিতে দেশীয় উৎসের বাইরে বিকল্প অর্থায়নের সব কটি পথ খোলা রাখারও প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছে সিপিডি।
ব্যাংকিং খাত: সিপিডি মনে করে, ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে এ খাতের ওপর আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনার পাশাপাশি মন্দ ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। সুশাসনের অভাব, ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে ৬৬ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য তৈরি হলেও সুদের হার কমছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে সাড়ে ১৮ শতাংশ ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও তা ১৩ শতাংশের নিচে রয়েছে। অর্থনীতিতে চাহিদা যে কমে গেছে, এটা তারই প্রমাণ। মূল্যস্ফীতি কম থাকলেও বিনিয়োগ বাড়ছে না, কারণ সুদের হার বেশি। আবার খেলাপি ঋণের কারণেই ব্যাংক সুদের হার কমাতে পারছে না।
পদ্মা সেতু: এ প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে যা হয়েছে, তাতে দুর্নীতি নাকি রাজনীতির বিষয়টি বড় ছিল, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কত কম সময়ে ও কম খরচে পদ্মা সেতু হতে পারে। তিনি এও বলেন, ‘এ ধরনের বড় অবকাঠামো নির্মাণে আমাদের মতো দেশে এখনো বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন রয়ে গেছে। নিজেদের অর্থে হয়তো আমরা এই সেতু করতে পারব, কিন্তু তাতে অন্য খাতের টানাপোড়েন দেখা দেবে।’
দেবপ্রিয় আরও বলেন, এখনো সময় আছে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে ফিরে গিয়ে সামগ্রিকভাবে সব দিক বিবেচনা করে অর্থায়নের পরিকল্পনা করার। অর্থায়নের বিকল্প উৎসগুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। দেশীয় বা বিদেশি যে অর্থেই সেতুটি নির্মিত হোক না কেন, বড় বিষয় হলো এই প্রকল্পে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সেতুর মান রানা প্লাজার মতো হলে সেটি দেশের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বাজেটে পদ্মা সেতুর জন্য সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হবে। এতে অন্যান্য খাতের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর জন্য বিদেশে বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু সেটির মাধ্যমে যদি কাঙ্ক্ষিত অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব না হয়, তাহলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি পরিস্থিতি: সিপিডি বলেছে, গত চার বছরে বিদ্যুতের প্রাপ্যতা বেড়েছে। চার বছর আগে বিদ্যুতের প্রাপ্যতা ছিল ৪৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশে। মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার গত এপ্রিল শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯২ কিলোওয়াটে। তবে উৎপাদন সক্ষমতা যে পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, সে পরিমাণ উৎপাদন বাড়েনি। ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হয়নি এ খাতে। বিদ্যুৎ সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (কুইক রেন্টাল) স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এর কারণে ভর্তুকির বোঝা তৈরি হয়েছে। কয়েক দফা দাম বাড়িয়েও ভর্তুকি কমানো সম্ভব হচ্ছে না। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অবসায়ন ঘটিয়ে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনায় তেমন কোনো অগ্রগতি ঘটেনি।
হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতা: হরতাল ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সমঝোতার রাজনীতির মাধ্যমে এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এর অভিঘাত সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য হবে। সিপিডি বলছে, হরতালের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি (বাজারমূল্যে) শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ কমে যায়। সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
রাজস্ব ও বৈদেশিক খাত: সিপিডি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে শ্লথ গতি সত্ত্বেও বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত খাতগুলোর অবস্থা বেশ ভালো ছিল। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ওপরে রয়েছে, প্রবাসী আয় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
সিপিডির শঙ্কা, রানা প্লাজার ঘটনা দেশের তৈরি পোশাক খাতে অভিঘাত ফেলতে পারে। অগ্রাধিকার বাজার-সুবিধা (জিএসপি) বা ক্রেতার দিক থেকে এই অভিঘাত আসতে পারে। তাই অভিঘাত মোকাবিলায় যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়নে বাজেটে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানি-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিদ্যমান বাজার ধরে রেখে দক্ষিণ-দক্ষিণ বাণিজ্যে (বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ) বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
শেয়ারবাজার: শেয়ারবাজার ধসে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের সুদ মওকুফ-সুবিধা কার্যকর করতে ৯০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে সংস্থাটির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এই উদ্যোগ আরও আগে গ্রহণ করা উচিত ছিল বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে এ ধরনের তহবিল গঠনের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে—এমনটা ধারণা করা ঠিক হবে না বলেও জানান তিনি। তাঁর মতে, পুঁজিবাজারের তহবিলজনিত কোনো সংকট নেই। সংকট হলো আস্থার।
এ প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পুঁজিবাজারে সুশাসনের পরিবর্তে সরকার ৯০০ কোটি টাকার তহবিল জোগান দিচ্ছে। এই প্রণোদনা রাষ্ট্রীয় অর্থে ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ।

No comments

Powered by Blogger.