নির্বাচন স্বচ্ছ না হলে মাশুল দিতে হবে অর্থনীতিকেঃ সিপিডি

সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন না হলে আগামী অর্থবছরের অর্থনীতিকে চরম মাশুল দিতে হবে। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির হার আরও হ্রাস পাবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘কারেন্ট  চ্যালেঞ্জ অব বাংলাদেশ ইকোনমি’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় সিপিডি। সম্মেলনে দেশের চলমান অর্থনীতির সাতটি বিষয়ের ওপর গবেষণাপত্র পাঠ করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান। ধানমন্ডির প্রধান কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় সিপিডির সম্মানিত ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, গবেষণা প্রধান ড. ফাহমিদা খাতুন, সিনিয়র গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও কো-অর্ডিনেটর তৌফিকুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন। সিপিডি জানায়, রাজনৈতিক সহিংসতা ও হরতালের মতো কর্মসূচি অর্থনীতির ক্ষতি করছে। রাজনীতি এবং অর্থনীতির সঙ্গে একটি দ্বন্দ্ব চলছে। একই সঙ্গে দূরত্বও তৈরি হয়েছে। আগামী ৬ মাস রাজেনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে অর্থনীতির দূরত্ব বহাল থাকবে। ফলে সরকারকে এখনই আগামী ৬ মাসের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হবে। অন্যথায় সরকারের শেষ দিকে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আরও কমে যেতে পারে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনেই এবারও বাজেট দেবেন অর্থমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
পদ্মা সেতু বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, পদ্মা সেতুর বিষয়ে রাজনীতি বা দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যত দ্রুত সময়ে কম ব্যয়ে এ প্রকল্পটি করা যায় সেটা। তিনি বলেন, আসন্ন বাজেটে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হলে অন্য খাতে সমস্যা সৃষ্টি হবে। পদ্মা সেতু নিয়ে আগে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা বাদ দিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। দেবপ্রিয় বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার কি করছে এটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বর্তমান অবস্থায় মনে হচ্ছে সরকার দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু করবে। এতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কিছুটা ব্যাহত হতে পারে। কারণ, একটি প্রকল্পে এত বড় থোক বরাদ্দ রাখলে অন্য প্রকল্পে সমস্যা হবে। এছাড়া সরকার দেশীয় অর্থায়নে এটি করতে পারবে না বলে মনে হচ্ছে। এত বড় প্রকল্পে বিদেশী অর্থায়ন প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে করেন এই গবেষক। রেমিটেন্স, সভরেন বন্ড ও দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে তা থেকে ফিরে আসা উচিত বলে মন্তব্য করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমরা চাই না সরকার তড়িঘড়ি করে রানা প্লাজার মতো করে একটা সেতু করে ফেলুক। আমাদের অনুরোধ থাকবে আরও কিছু দিন দেখে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, সরকারের প্রথম তিন বছরের তুলনায় পরের দুই বছরে অর্থনীতি অনেকটা মন্থর হয়ে পড়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হলেও এটা পয়েন্ট ভিত্তিক কিছুটা কমছে। এজন্য অনেকে বিশ্ব বাণিজ্য মন্দার কথা বলে থাকেন। এটি সত্য নয়। বরং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সহিংসতা বেশি ক্ষতি করছে।
এর যুক্তি হিসেবে দেবপ্রিয় বলেন, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ছে। ফলে বৈদেশিক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত এমন সব সূচকই বেড়েছে। এর মধ্যে প্রবাসী আয় বেড়ে সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে। রপ্তানির প্রবৃদ্ধি এখনও ১০ শতাংশের বেশি। বৈদেশিক বিনিয়োগ আগের বছরের চেয়ে বাড়ছে। এমনকি বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। ফলে বিশ্ব মন্দার কোন প্রভাব পড়ছে না।
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে দেবপ্রিয় বলেন, ব্যক্তি খাতে ঋণ বিতরণ এবং অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কমছেই। এর মধে ব্যক্তিগত ঋণ সরবরাহ বা বিনিয়োগ গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্থানে আছে। মুদ্রানীতিতে সাড়ে ১৮ শতাংশ বেসকারি খাতে ঋণ অনুমোদন আছে। এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সঙ্গে আলোচনা করেই নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সেই ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। অর্থাৎ বিনিয়োগ স্থবির। অন্যদিকে আর অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খরচ বেড়েছে। এতে তাদের সঞ্চয় থাকছে না। বরং সঞ্চয় ভাঙিয়ে খরচ করতে হচ্ছে।
ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংকিং খাতে দুষ্ট চক্র ঢুকেছে। যেখানে বেসরকারি খাতে ঋণ যাচ্ছে না। অর্থাৎ মানুষ টাকা নিচ্ছে না। আবার ব্যাংকিং খাতে ৬০ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত আছে। এরপরও ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমছে না। এর কারণ হলো- ব্যাংকিং খাতে কু-ঋণ বাড়ছে। এসব কু-ঋণের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় বড় দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ব্যাংকিং খাতের সুদের হার কমাতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমলেও সুদ হার কমেছে না। এটি একটি ভাবনার বিষয়। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার করতে হবে বলে জানান তিনি। কুইক রেন্টাল প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জালানি সঙ্কটের কারণে কুইক রেন্টাল চলছে না। এরপরও সরকারের চুক্তি অনুযায়ী তাদের টাকা দিতে হচ্ছে। এতে সরকারের দুই দিক থেকে ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে সাবসিডি বাড়ছে অন্যদিকে এ খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে আসার একটি পলিসি বের করতে হবে। অন্যথায় অর্থনীতিতে একটি বড় বোঝা তৈরি হবে।

No comments

Powered by Blogger.