বাজেটে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি বড় চ্যালেঞ্জ: ড. আশিকুর রহমান by মনোয়ারুল ইসলাম

বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিকে আসন্ন বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করলেন দেশের খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।
আসন্ন বাজেট সামনে রেখে তার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় এবং বাজেট সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।

ড. আশিকুর বলেন, সরকারি উদ্যোগ আর পরিবেশের অভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। এমন কি দেশি বিনিয়োগও আশানুরূপ নয়। তাই সরকারকেই বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

একই সঙ্গে রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার করেও বাজেট প্রণয়নের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমানের গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলায়। পড়াশোনা করেছেন বিদেশের একাধিক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে।

রাজনৈতিক অর্থনীতিতে তিনি পড়াশোনা করেন বিশ্বের খ্যাতনামা লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে। কর্মজীবনে বিশ্বব্যাংক, জাইকা সহ দেশি বিদেশি অনেক খ্যাতনামা সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। পাশাপাশি রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর তার রয়েছে উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম।

পিআরআই’এর বনানী অফিসে বসে দেওয়া সাক্ষাতকারে ড. আশিকুর রহমান আরও বলেন, আসন্ন বাজেটে বিদুৎ, গ্যাস, অবকাঠামো উন্নয়ণ, যোগাযোগ, আইসিটি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে।

প্রযুক্তিখাতকে দ্রুত বর্ধনশীল খাত উল্লেখ করে তিনি আসন্ন বাজেটে ইন্টারনেটের মূল্য কমানো, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব, পিসির ওপর শুল্কহার কমানো সহ এসব বিষয়ে বিশেষ সুবিধা থাকার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ইন্টারনেট সেবা যত সহজলভ্য হবে অর্থনীতি ও দেশের অন্যান্য সেক্টর তত গতিশীল হবে। কেননা ইন্টারনেট একটি মৌলিক সেবা। অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে এই খাতের গুরুত্ব বুঝতে হবে।

এছাড়া ঢাকা চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক, সমুদ্র বন্দর ও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে যোগাযোগ সহ রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তিনি।

আশিকুর রহমান বলেন, বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এখনো বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও সুশাসনের অভাবের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ সন্তোষজনক নয়। এমনকি দেশি অনেক উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তার বিষয়টি বিবেচনা করেন।

বাজেটে এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশের বিদুৎ, গ্যাস, অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় জাইকার অনেক বড় ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে।পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে নানা রকম সমস্যার পর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।মেট্রো রেল প্রজেক্ট পদ্মার থেকেও বড় প্রকল্প।আমাদের নীতি হওয়া উচিত “উইন উইন”।এতে বিদেশিরা আমাদের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করবে।বিশ্বের অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ারগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে তাদেরকে সরাসরি বিনিয়োগে আনতে হবে।”

বাজেট প্রণেতাদের বিষয়ে তিনি বলেন, বাজেটের বিষয়ে সরকারের অর্থনীতি গবেষণা, প্লানিং কমিশন আছে।সরকারের অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছে, তারা আমলাতন্ত্রের যোগ্য মানুষ।কিন্তু অর্থমন্ত্রী বা বাজেট প্রণেতাদের অর্থনীতিতে বড় বড় ডিগ্রী থাকতে হবে তা নয়।আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন সামরিক বাহিনীর জেনারেল ছিলেন।তিনি অর্থনীতির ওপর কোন ডিগ্রীও নেননি।কিন্ত আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদেরকেই বাস্তবমুখী হয়ে বাজেটের জন্য কাজ করতে হবে।তবে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে জনগণের কল্যাণকে।

গত ৩ টি বাজেটে স্বাস্থ্যখাত প্রাধান্য পাচ্ছে না উল্লেখ করে ড. আশিক বলেন, “গত ৩ টি বাজেটে দেখেন স্বাস্থ্যখাত অনেক কম বরাদ্দ পেয়েছে।স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রাধান্য পেতেই হবে।আর বাজেটে শুধু বরাদ্দ দিলেই হবে না।সেই অর্থ কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে তা যাচাই করতে হবে।আমরা বাজেটে স্থানীয় সরকার উন্নয়নে বেশ বড় আকারের বরাদ্দ দেই।এটা কতটুকু কার্যকর, কতটুকু কাজে লেগেছে, তা বের করতে হবে।বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সহ সব সেক্টরে গতিশীল অর্থনীতি দরকার।”

রাজনীতি ও অর্থনীতির এই গবেষক মনে করেন, দেশের অর্থনীতিকে দু’একটি সেক্টরের উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না।বিকল্প দেখতে হবে।কারণ গার্মেন্ট সেক্টরের পরনির্ভরশীলতা অনেক বেশি। এর বিকল্প আইটি সেক্টর, জনশক্তি, মোটর অ্যাসেম্বলিং সেক্টর ভালো বিকল্প হতে পারে।তাই দেশেই যেসব কোম্পানি মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, ফ্রিজ বা গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি করে তাদেরকে বিশেষ সুবিধা দিতে হবে।

বাংলাদেশের গতানুগতিক বাজেটের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “শিক্ষা খাতের বাজেটে বিজ্ঞানভিত্তিক, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষাকে বেশি বরাদ্দ দেওয়া উচিত।আমাদের পররাষ্ট্রনীতিরও পরিবর্তন দরকার। পূ্র্বমুখী বা পশ্চিমুখী নীতির চেয়ে যেখানে লাভ ও প্রয়োজন সেখানেই বন্ধুত্ব দরকার।টিকফা ব্যবসা বাণ্যিজ্যের প্রসারের জন্য দরকার।তবে জিএসপি সুবিধা ঠিক রাখতে ও সম্প্রসারণেও চেষ্টা করতে হবে।

দলীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে বাজেট প্রণয়ণ করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখে বাজেট তৈরি করতে হবে। নির্বাচন মাথায় রেখে দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইলে প্রত্যাশিত বাজেট জনগণের কল্যাণে আসবে না।

আওয়ামী লীগের অর্থনীতিক ‘ভিশন’ এর প্রশংসা করে তিনি বলেন, “‘ভিশন-২০২১’ এর মাধ্যমে সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিলো দেশকে একটি গাইডলাইন দেওয়া।আমাদের সবচেয়ে বড় ‘গোল’ একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া।বাস্তবে সরকারের ঘোষিত ডিজিপি প্রবৃদ্ধি বারবার মিস করছি।কারণ প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ আশানুরূপ বাড়েনি।পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিকে পিছিয়ে দিতে একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে।”

এবারের বাজেটে দেশকে যেন একটি অর্থনৈতিক গন্তব্য দিতে পারে সরকারের প্রতি তিনি সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এছাড়া বাজেটে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলনের ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.