যুবক, ছুঁয়ে যাও মানবিক হৃদয়... by রিফাত মুনীর ইতি

একাত্তরের অদেখা মুক্তিযুদ্ধ এক নিবিড় ছাপ ফেলেছিল এ সময়ের দুরন্ত কিছু যৌবনের কাছে। তারা মুক্তির মানে বুঝতে পেরেছিল, তারা জানতে পেরেছে লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা, তারা একাত্তরে সম্ভ্রম হারানো হাজারো মা-বোনের কষ্ট উপলব্ধি করেছে অন্তরে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তাই তাদের একতাবদ্ধ আন্দোলন এ দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আমরা দেখেছি গণজোয়ার। আমরা দেখেছি বুদ্ধিজীবীর সন্তানদের কান্না, তাদের প্রিয়জন হারানোর হাহাকার। এক সাক্ষাৎকারে মনে পড়ে, বীরজায়া পান্না কায়সার বলেছিলেন, 'শমী (বুদ্ধিজীবী কন্যা ও অভিনেত্রী) তার বাবাকে খুব মিস করে।' স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক এক বছর আগে জন্ম নেওয়া শমী কায়সারের স্মৃতিতে বাবা হয়তো পুরোপুরি নেই, কিন্তু ঠিক একইভাবে শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ, সাংবাদিক নিজামউদ্দীন, সিরাজুদ্দীন, জহির রায়হান প্রমুখের সন্তানরাও একই যন্ত্রণা লালন করেন বুকে প্রতিদিন, প্রতিমূহূর্তে। আশার কথা, এই যন্ত্রণা এখন ছুঁয়ে গেছে প্রজন্মকেও। তারা সোচ্চার হয়েছে, তাদের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শপথ নিতে আসা তরুণদের চোখে ছিল জল, ছিল এক বীরাঙ্গনার আর্তনাদ, যা আপামর জনসাধারণকে কাঁদিয়েছে, ছুঁয়ে গেছে সাধারণ মানুষের হৃদয়। এই তো যৌবন, এই তো শোককে শক্তিতে পরিণত করার বাস্তবিক অভিজ্ঞতা।
ভাবতে ভালো লাগে, সমস্যা জর্জরিত রাজনৈতিক কোন্দলের এই ছোট্ট দেশটিতে আজও হযরত আলীর মতো কেউ কেউ ছিনতাইকারীর সঙ্গে এক রকম যুদ্ধ করতে গিয়ে ছুরিকাহত হন এক সুন্দর সকালে অপরিচিত একজনের উপকার করতে গিয়ে। অন্যভাবে বলা যায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দিলি্লর ধর্ষিত মেয়েটির মতো বাংলাদেশেও এক নিদারুণ অযাচিত অন্যায় প্রতিরোধ করে দেন এক সাহসী মানুষ। ধর্ষণের প্রায় শিকার হতে যাওয়া তরুণীকে নিজের বোনের মতো মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিবাদে, প্রতিরোধে। অপরাধীদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেন। অপরাধীরা শত হলেও অন্তত ধৃত হয়।
হরতাল, রাজনৈতিক সহিংসতার দেশটিতে ভয়ঙ্কর অভিশাপ হয়ে নেমে আসে ভবনধস। হাজারো পোশাক শ্রমিক চাপা পড়েন বিশাল ভবনের তলে, মৃত মানুষের লাশে, আহতদের আজাহারি আর স্বজনের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে সাভারের বাতাস। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে এই বাংলার যুবকরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নেমে যান ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃত লাশ ও জীবিতদের উদ্ধারের কাজে। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, তাদের মানবতায়, তাদের মহানুভবতায় উদ্ধার পাওয়া জনগণের সঙ্গে সঙ্গে পুরো দেশের হৃদয় কেঁপে ওঠে। আত্মীয়-পরিজনহীন মানুষ এত মহৎ প্রাণের সহযোগিতা পেয়েছে, যা সত্যিই অভূতপূর্ব। উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করে, নিজের রক্ত দিয়ে আহতদের সেবায় এগিয়ে এসে, নিজ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারকাজে নেমে তারা প্রমাণ করেছেন, অন্তরের উদারতা অন্তরের গভীর ভালোবাসা মানুষের জন্য, মানবতার তরে। উদ্ধারকাজে নেমে কায়কোবাদের মৃত্যু জাতিকে কাঁদিয়েছে, যেমন জীবিত শাহীনাকে উদ্ধার করতে না পেরে কেঁদেছিলেন উদ্ধারকর্মীরা। সদ্য বিবাহিত ওমর ফারুকের স্ত্রীর হাতের মেহেদির রঙ মুছে গেছে, বিশ্বমানবতার ত্যাগের এক অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা।
পাঠক, ব্যক্তিগত হলেও একটা ছোট্ট ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। একটা বেসরকারি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছি আমি। সাভারের ভবনধসের কথা শুনে প্রতিষ্ঠানের তরুণ শিক্ষকদের রক্তদানের সঙ্গে সঙ্গে এক শিক্ষার্থী এসে বলল, ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিতদের উদ্ধারের কাজে সে তিনতলা পর্যন্ত নেমেছিল। ছাত্রের কথা শুনে চোখে জল চলে আসে আমার। এই তো কবি নজরুলের ভাষায়, যৌবনের মাতৃরূপ, এই তো আর্তের কল্যাণে এগিয়ে আসার মহৎ উদাহরণ। হৃদয় ঐশ্বর্যে দেশটা যে কত বড় তা আবার প্রমাণিত হলো। হতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য চিরসঙ্গী, কিন্তু আমাদের হৃদয়, বিশেষত আমাদের যুব সমাজের সব বিপদে সক্রিয় অংশগ্রহণ তো সত্যি সত্যি পৃথিবীতে বিরল। বিশ্ববাসীর কাছে এক চাক্ষুষ উদাহরণও বটে।
আমরা আশাবাদী, একাত্তরে সংকটে বীরশ্রেষ্ঠরা সম্মুখ সমরে মাথা নোয়াননি। শহীদ রুমি, বদি, আজাদের মতো তরুণরা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। আমি জানি, তোমরাও তেমন যুবক, তোমরা আরও এগিয়ে যাবে, আরও...।
স রিফাত মুনীর ইতি
কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.