বিশ্ব অর্থনীতি ও আগামী দিনের বাংলাদেশ by ইফতেখার আহমেদ টিপু

যেকোনো দেশের চালিকাশক্তি তার অর্থনীতি। এই অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে সেই দেশের বাণিজ্যচক্রের ওপর। এই বাণিজ্য আবার বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অর্থপ্রবাহ বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিকের মৃত্যু এবং প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক আহত হওয়ার ঘটনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নয়নের দাবি জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন শ্রমিক সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার, তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন ও মার্কিন ক্রেতাদের সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গার্মেন্ট শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পোশাক ক্রেতাদেরও উদ্যোগ নিতে হবে। গার্মেন্ট শিল্পে একের পর এক দুর্ঘটনায় এ শিল্পের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। সস্তা শ্রমের কারণে বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকের দাম যেকোনো দেশের চেয়ে কম। পোশাকের দাম কম রাখার ক্ষেত্রে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের সস্তা শ্রম মালিকপক্ষের ভাগ্য যেমন ফেরাচ্ছে, তেমনি সমৃদ্ধ করছে দেশের অর্থনীতি।
গার্মেন্ট শিল্পের অধঃপতিত ভাবমূর্তির উন্নয়ন ও স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে সম্প্রতি গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
গার্মেন্ট শিল্পের ভাবমূর্তি পুনর্গঠন ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় নতুন বেতন বোর্ড গঠন একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। মালিকপক্ষের পরামর্শে এ উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টিও তাৎপর্যের দাবিদার। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প ও এর সমস্যার ওপর সারা বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে। এ সময়টিকে কাজে লাগিয়ে যত দ্রুত সম্ভব গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিক ও মালিক তথা বিনিয়োগের স্বার্থ রক্ষায় সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে মূলত বিরোধী দল ও জোটগুলো একের পর এক হরতাল দিয়ে যাচ্ছে। হরতালের সহিংসতা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার কারণে সার্বিক জীবনযাত্রার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও ভয়াবহ রাহুর কবলে পড়েছে। হরতাল, রাজনৈতিক সহিংসতা, নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলার কারণে উৎপাদনবান্ধব পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ওপর। হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতা আঘাত হেনেছে অর্থনীতির মূল ভিত্তিতে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েছে। হরতালের নামে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, জীবনহানিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ১০ বছর ধরে যে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে, এর বড় কারণ হলো, অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও স্বাভাবিক প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে অর্থনীতির। হরতালের কারণে অতিমাত্রায় চাপে পড়লে সে ক্ষমতা কমে যাবে। ফলে ধ্বংস হবে অর্থনীতি।
সম্প্রতি প্রকাশিত ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ডিসিসিআইয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, গত পাঁচ মাসের হরতালে বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তৈরি পোশাক খাত। বাস্তবে হয়তো ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হবে। জানুয়ারি থেকে মে- এই পাঁচ মাসে দেশব্যাপী হরতাল হয়েছে ৩২ দিন। এর বাইরে আঞ্চলিক হরতাল ও অবরোধসহ অন্যান্য কর্মসূচি ছিল, যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করেছে। ডিসিসিআই গবেষণা করে দেখিয়েছে যে প্রতিদিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে ৩২ দিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষতির শীর্ষে আছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প। এক দিনের হরতালে পোশাকশিল্পে ৩৬০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। আর ৩২ দিনের হরতালে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।
ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সহিংসতা ও হরতালের ধারা বহাল থাকলে প্রবৃদ্ধির ওপর পড়বে মারাত্মক প্রভাব। এমনিতেই অর্থনীতিতে অশনিসংকেতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের গর্জন দেখা দিয়েছে। কালো মেঘের গর্জন বন্ধ করতে হলে সবাই মিলে একত্রে বসে সমাধানের পথ বের করতে হবে। না হলে ধ্বংস অনিবার্য।
অর্থনীতি একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি। অথচ আমাদের দেশে একের পর এক হরতালের কারণে বাণিজ্য ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। শুরু হয়েছে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশে আসবে না। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। সবার জানা উচিত, পঙ্গু-স্থবির অর্থনীতির দেশ কখনো স্বনির্ভর হতে পারে না। অথচ জাতির সেই মূল প্রাণশক্তি অর্থনীতিকে আমরা তিলে তিলে ধ্বংস করে চলেছি অপরিণামদর্শীর মতো। দেশের অর্থনীতি বাঁচলে দেশ বাঁচবে; আর দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও বাঁচবেন- এই মৌল সত্যটিকে অগ্রাহ্য করে জাতীয় অর্থনীতি বিধ্বংসী যে সর্বনাশা রাজনীতি শুরু হয়েছে; জনগণের স্বার্থের নামে জাতিবিনাশী যে বিচার-বিবেচনাহীন তৎপরতা চলছে, তা অব্যাহত থাকলে আমরা কেউ এ ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাব না।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ,
চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ।
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.