একজন শ্বেতাঙ্গের স্মৃতিতে ম্যান্ডেলা

ম্যান্ডেলার সঙ্গে নাদিয়া বিলশিক
কয়েকবার নেলসন ম্যান্ডেলার মুখোমুখি হয়েছেন মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএনের সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত নাদিয়া বিলশিক। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসন ও ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী এই শ্বেতাঙ্গ নারী আমার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৯৬৪ সালে। ওই বছর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন, যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন পাস হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় নেলসন ম্যান্ডেলার। জোহানেসবার্গের এক শহরতলিতে তুলনামূলক নির্ঝঞ্ঝাট ও সমৃদ্ধ পরিবেশে শৈশব কাটিয়েছি আমি। দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য অনেক শ্বেতাঙ্গ নাগরিকের মতো আমার চারপাশে ছড়ানো ছিল সুযোগ-সুবিধা। আমাদের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত ছিল দুজন পরিচারিকা, একজন মালি ও একজন গাড়িচালক। রোজিনা ও ফিনা নামের ওই কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারিকারা সন্তান-সন্ততি নিয়ে আমাদের সঙ্গেই থাকত। তবে তাদের পুরো নাম জানারও গরজ বোধ করিনি আমরা। তবে মারাত্মক কোনো একটা ভুলের অস্তিত্ব আমি কৈশোরেই টের পাই। একদিন আমি ও পরিচারিকা ফিনা শ্বেতাঙ্গ-অধ্যুষিত একটি এলাকায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ পুলিশের একটি ভ্যান সেখানে থামল। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ আশপাশের সব কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। তারা অনেককে টেনেহিঁচড়ে ভ্যানে তুলে নিল। আমি ভয় পেয়ে যাই এবং ফিনাকে জিজ্ঞেস করি, ‘এসব কী হচ্ছে।’ সে বলে, পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে। জোহানেসবার্গে শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় সরকারি অনুমতিপত্র ছাড়া কোনো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের চলাফেরার অধিকার নেই। সেদিনই উপলব্ধি করি, বর্ণবাদের কলুষ থেকে আমিও আর মুক্ত নই। ধীরে ধীরে আমি প্রথমবারের মতো নেলসন ম্যান্ডেলা ও আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস সম্পর্কে জানতে পারি। এক সময় ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা’-এর মতো গান আমাদের চেতনার অংশে পরিণত হয়। সোয়েটো দাঙ্গা সংঘটিত হয় ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন। সেদিন ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। স্থানীয় ভাষায় পড়ানো যাবে না—এ মর্মে সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিল। সেদিন শত শত মানুষ নিহত হয়। সরকারি বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিক্রিয়ায় আশপাশের অঞ্চলে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেটাই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের শুরু। বর্ণবাদের অপরাধ যে কতটা ক্ষমার অযোগ্য, সে সম্পর্কে সত্যিকার উপলব্ধি কিছুটা হয় ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে। আমার বয়স তখন ২০-এর কোঠার শেষ দিকে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের সম্মিলিত সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার পাশে ছিলেন ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। জীবনে প্রথমবার কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে এসেছিলেন তিনি। তাঁকে দুবার বাসে চড়ে এবং ১০ মাইল হেঁটে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছাতে হয়। আমার পাশে ছিলেন সালামিনাও। এ নারী আমাকে সন্তান লালনে সহায়তা করতেন এবং ক্রমে আমাদের পরিবারেরই অংশ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ৫৫ বছর বয়সে এসে তিনি নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। ১৯৯০ সালে ম্যান্ডেলার কারামুক্তির ঘটনাটি ছিল একই সঙ্গে অত্যন্ত প্রত্যাশিত এবং আতঙ্কজনক ব্যাপার। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের অনেকে উচ্ছেদ, শাস্তি বা সরকার পরিবর্তনের আশঙ্কা করছিলেন। যেকোনো বিপ্লবের পর এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু উল্টো ম্যান্ডেলা যখন সমঝোতা ও সব জাতি মিলিয়ে ‘রংধনু দেশ’ (রেইনবো নেশন) গঠনের কথা বললেন, তখন শ্বেতাঙ্গরা কতটুকু স্বস্তি পেয়েছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তখন থেকেই শান্তিবাদী, রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ম্যান্ডেলার উত্থানের শুরু। জীবনে এত অর্জনের পরও ম্যান্ডেলার সমালোচনা যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। অনেকে মনে করেন, তিনি খুব বেশি সমঝোতাকামী ছিলেন। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতিকে বদলে দেওয়ার কাজ খুব কমই করেছেন। ৯৪ বছর পেরিয়ে ম্যান্ডেলা অন্য যেকোনো মরণশীল সত্ত্বার মতোই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানানো হয়েছে। ম্যান্ডেলা সব সময়ই শ্রদ্ধার প্রতিমূর্তি হিসেবে রয়ে যাবেন। কারণ, তিনি একটি দুঃস্বপ্নকে একটি দর্শনে, একটি দর্শনকে একটি স্বপ্নে এবং একটি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করেছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.