গাজীপুর সিটি নির্বাচন-দুই প্রার্থীরই টার্গেট টঙ্গী-নবনির্বাচিত চার মেয়রও প্রচারে নামছেন by শরীফ আহ্‌মেদ শামীম

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জনসমর্থন আদায়ে চষে বেড়াচ্ছেন সিটির পাড়া-মহল্লা। তবে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন সমীকরণ সামনে হাজির হচ্ছে।
কয়েক দিন ধরে গাজীপুরের সর্বত্র জোরেশোরে একটি কথাই বলাবলি হচ্ছে- টঙ্গীর ভোটের মোড় যেদিকে ঘুরবে, জয় তাঁরই হবে। স্বভাবতই নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ১৪ দল সমর্থিত আজমত উল্লা খান ও ১৮ দল সমর্থিত অধ্যাপক আবদুল মান্নান টঙ্গীর দিকে আলাদাভাবে নজর দিচ্ছেন। টঙ্গীকে টার্গেট করে মাঠে নেমেছেন প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও। নির্বাচনী প্রচারে শামিল হতে আসছেন চার সিটির সদ্যনির্বাচিত মেয়ররাও।
টঙ্গীর ভোটার সাড়ে তিন লাখ, যা মোট ভোটের তিন ভাগের এক ভাগ। এখানকার অধিকাংশ ভোটারই পেশায় শ্রমিক এবং বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লার বাসিন্দা। টঙ্গীর ভোটের এই দুর্গ দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের দখলে। আজমত উল্লা খান টঙ্গীর বাসিন্দা। আঞ্চলিকতার কারণে টঙ্গীতে তিনি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। অধ্যাপক মান্নান চাইছেন টঙ্গীতে আজমত উল্লা খানের ভোট ব্যাংকে ভাগ বসাতে। বিএনপি সেই দুর্গ আয়ত্তে নিতে মরিয়া। নোয়াখালী ও কুমিল্লার নেতাদের কাজে লাগানোর পাশাপাশি সমর্থন আদায়ে স্থানীয়ভাবেও নির্বাচনী প্রচার চলছে জোরেশোরে।
মান্নান নিজে এবং তাঁর হয়ে প্রচার চালাতে আসা ১৮ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় নেতারাও প্রচারে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন টঙ্গীর ভোটারদের। তাঁর পক্ষে ভোট চাইতে আসছেন সম্প্রতি দেশের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী মেয়ররাও।
বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বসে নেই আজমত উল্লা খান ও তাঁর কর্মী-সমর্থকরা। দিনভর অন্যান্য ওয়ার্ডে গণসংযোগের পাশাপাশি প্রতিদিনই তিনি অতিরিক্ত কিছু সময় ব্যয় করছেন টঙ্গীর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। তাঁর কর্মী-সমর্থকরাও টঙ্গীর ভোট ব্যাংক আগলে রাখতে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে শক্ত ব্যারিকেড গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক মান্নান বা তাঁর হয়ে আসা নেতা-কর্মীরা যেসব এলাকায় ভোটারদের কাছে যাচ্ছে, আজমত উল্লার কর্মী-সমর্থকরাও কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হচ্ছে। চলছে ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনা।
টঙ্গীর এরশাদনগরের বাসিন্দা বাংলাদেশ সম্মিলিত টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা বুলবুল আহাম্মদ জানান, শিল্পনগরী টঙ্গীর শ্রমিকদের দেশের আন্দোলন-সংগ্রামেও রয়েছে বিরাট ভূমিকা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে টঙ্গীর শ্রমিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ সরকার পরিবারের হাতেই ছিল। পরে ১৯৯৫ সালে তা উল্টে যায়। বিএনপি আমলে ১৯৯৪ সালে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে টঙ্গীর বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত টেক্সটাইল কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়ে হাজার হাজার শ্রমিক। ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত টঙ্গী পৌরসভা নির্বাচনে এ ইস্যু কাজে লাগিয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন আজমত উল্লা। তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। দল ক্ষমতায় এলে বন্ধ কারখানা চালুর আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। সরকারের শেষ সময়েও সেই আশ্বাস বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি। তা ছাড়া বেসরকারীকরণের আওতায় টঙ্গীর সবচেয়ে বড় চারটি কারখানা শ্রমিক-কর্মচারীদের টাকায় কেনা হলেও পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে দলীয় নেতাদের হাতে। নেতারা বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে গেলেও শ্রমিকদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তার ওপর টঙ্গীর জলাবদ্ধতা নির্বাচনে ভোটারদের মাঝে অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। অধ্যাপক মান্নান এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আজমত উল্লার ভোট ব্যাংকে হানা দিতে চাচ্ছেন। অনেক শ্রমিক ও সাধারণ ভোটার ইতিমধ্যে মান্নানের পক্ষে প্রকাশ্যেই মাঠে নেমে পড়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টঙ্গীর মুন্নু টেক্সটাইল শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক এক নেতা জানান, পারিবারিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক কারণে টঙ্গীর শ্রমিকদের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন সাবেক এমপি হাসান উদ্দিন সরকার। অতীতে দলীয় কোন্দল ও দ্বন্দ্বের কারণে হাসান সরকার সমর্থিত শ্রমিক ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভোট আজমত উল্লা পেতেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়ায় হাসান সরকার টঙ্গীর অলিগলিতে এমনকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মান্নানের জন্য ভোট চাইছেন। তা ছাড়া টঙ্গীর ভোটাররা শেষ সময়ে সরকারের জনপ্রিয়তা, এলাকায় গ্যাস সংকট, জলাবদ্ধতা, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য, এলাকায় মাদক ও সন্ত্রাস বিস্তারের মতো বিষয়গুলোও হিসাব-নিকাশ করছে।
টঙ্গী থানা যুবলীগের সাবেক সদস্য শাহজাহান খান বলেন, 'নির্বাচনে বিএনপি টঙ্গীকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, তা আমরাও জানি। কিন্তু টঙ্গীর মানুষ অতীতের মতো আজমত উল্লাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।'
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি এনামুল হক শামীম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা লিয়াকত শিকদার, পংকজ সাহা, জহির উদ্দিন লিপটন, শাহজাদা মহিউদ্দিন স্থানীয় নেতাদের নিয়ে গতকালও টঙ্গীতে ব্যাপক গণসংযোগ করেন। গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল এবং আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছোট ভাই মতিউর রহমান মতি বিশেষ টিম গঠন করে কাজ করছেন। বিএনপির অতীত কর্মকাণ্ড ও আজমত উল্লার উন্নয়নের কারণে ভোটাররা এবারও ভুল করবে না বলে মনে করেন তাঁরা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও অধ্যাপক মান্নানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী হাসান উদ্দিনও স্বীকার করেন, জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা টঙ্গীর ভোটারদের হাতে থাকবে। তিনি বলেন, 'টঙ্গী রাজধানীর সবচেয়ে কাছের শহর। এখানে শিক্ষিত মানুষের পাশাপাশি লাখ লাখ মেহনতি শ্রমিকও বাস করে। আমরা তাদের ভোট পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।' বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শ্রমিক নেতা নজরুল ইসলাম খান টঙ্গীর শ্রমিক নেতাদের নিয়ে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিরামহীন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। অধ্যাপক মান্নান, হান্নান শাহ, আমানউল্লাহ আমান, ফজলুল হক মিলনও টঙ্গীতে কাজ করছেন। নজরুল ইসলাম খান বলেন, 'তাৎপর্যের বিষয় হলো, অনেক ভোটার স্বেচ্ছায় এসে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। অতীতে এমনটা আর হয়নি। এসব কারণে টঙ্গীর ভোটের বড় অংশ আমরা পাওয়ার আশা করছি।' তিনি জানান, সম্প্রতি চার সিটি করপোরেশনে বিজয়ী মেয়রদেরও অধ্যাপক মান্নানের পক্ষে ভোট চাইতে আসার কথা রয়েছে। টঙ্গী থেকেই তাঁরা মান্নানের জন্য প্রচার শুরু করবেন।

No comments

Powered by Blogger.