অনলাইন থেকে-ম্যান্ডেলার পাশে বিশ্ব প্রচারমাধ্যম

ম্যাক মাহারাজ ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও একসময়ের সহকর্মী। ম্যান্ডেলার ঘটনাবহুল জীবনচিত্র বিশ্বসভায় স্থান পাওয়ার পেছনে সর্বাধিক অবদান রয়েছে তাঁর।
১৯৭০ সালে দুজনই ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের চক্ষুঃশূল। একই সঙ্গে ছিলেন কুখ্যাত রবেন দ্বীপের কারাগারে। ওই কারাগার থেকে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ 'লং ওয়াক টু ফ্রিডম' পাচার করে দেন বাইরে। ইতিহাসের সাক্ষী মাহারাজই কিংবদন্তিতুল্য ম্যান্ডেলার জীবনের আরেকটি অধ্যায়কে জনসমক্ষে প্রকাশের দায়িত্ব পালন করছেন, যা হতে পারে ম্যান্ডেলা গল্পেরও শেষ অধ্যায়। পূর্ণাঙ্গ ম্যান্ডেলা চরিত্রচিত্রণে এটিই হতে পারে সর্বগ্রাহ্য মাধ্যম।
সোমবার মাহারাজ সাংবাদিকদের অবহিত করেছেন, ম্যান্ডেলার শারীরিক অবস্থা কঠিন পর্যায়ে উপনীত। ফুসফুসের মারাত্মক সংক্রমণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে কোনো কোনো প্রচারমাধ্যম ম্যান্ডেলা সম্পর্কে মনগড়া সব তথ্য প্রচার করছে। তারা একজন রোগীর গোপনীয়তাও ভঙ্গ করছে। চিকিৎসকদেরও তারা অনেক সময় বিরক্ত করছে, যা মোটেও কাম্য হতে পারে না।
ম্যান্ডেলার জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে- এমন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে তখনই যখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা প্রতিবেশী মোজাম্বিক সফর বাতিল করেছেন, তখন এই তথ্য আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। জ্যাকব জুমা হাসপাতালে ম্যান্ডেলাকে দেখে আসার পর প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে তাতেও উল্লেখ আছে ম্যান্ডেলার অবস্থা সংকটাপন্ন।
এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমকে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করেছে। ১৯৯০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ ম্যান্ডেলার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর যে ঢেউ দেখা গিয়েছিল, এর চেয়েও বেশি দেখা যাচ্ছে এখন। সারিবদ্ধ স্যাটেলাইট ডিশ, সাংবাদিকদের গাড়ির ভিড় লেগে আছে প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিন হার্ট হসপিটালের পাশের সরু রাস্তায়। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসা কোনো ভিজিটর দেখলেই ক্যামেরাচালক, প্রতিবেদক ও ফটোসাংবাদিকরা জেঁকে ধরেন। একসময় ওই জায়গায় শুধুই শ্বেতাঙ্গদের আবাস ছিল, যা এখন কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আশপাশের ভবনগুলোতেও সাংবাদিকদের ভিড়। রাস্তার পাশের একটি ভবনের ব্যালকনি ভাড়া নিয়েছেন অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোসাংবাদিকরা। আর এর জন্য মোটা অঙ্কের অর্থও প্রদান করতে হয়েছে তাঁদের। একটি ভবনের টয়লেটও ভাড়া হয়েছে, যেখান থেকে হাসপাতালের প্রবেশপথ স্পষ্ট দেখা যায়। আশপাশের ভবনগুলোতেও যেখানে সংবাদ ও চিত্রগ্রাহকদের ভিড় সেখানে দেখা গেছে আরেক দল মানুষ বিদেশি সাংবাদিকদের সহ্য করতে পারছে না। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বলছে, তোমরা কেন এসেছ? তাঁর মৃত্যু হয়নি, হতে পারে না, তোমরা ফিরে যাও। এমন সংবাদ আমরা চাই না। ম্যান্ডেলার সাবেক স্ত্রী উইনি যখন হাসপাতালে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন, তখন একজন প্রহরী সাংবাদিকের ক্যামেরা ভেঙে ফেলেছে, যে কারণে কোনো কোনো সংবাদকর্মী বিশেষ করে সিএনএন ও বিবিসির কর্মীদের জন্য বিশেষ প্রহরার ব্যবস্থা করতে হয়েছে প্রশাসনকে। গার্ডিয়ানের, ডয়েচের বক্তব্য অনুযায়ী, আফ্রিকার মানুষ এই সংবাদ সংগ্রহকারীদের ভিড়কে আক্রমণাত্মক মনে করছে। তারা এ ধরনের ভিড় সহ্য করতে পারছে না। আবার দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক মানুষ এই সংবাদ প্রক্রিয়াকে স্বাগতও জানাচ্ছে। তাদের বিশ্বাস, এতে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার প্রতি বিশ্বের মানুষের শ্রদ্ধাই প্রকাশ পাচ্ছে।
ম্যান্ডেলার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে সেখানে রাজনৈতিক আবহও গরম। বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিরোধী পক্ষ ম্যান্ডেলার চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আনছে। ৮ জুন সিবিএস প্রচার করে, ম্যান্ডেলাকে বহনকারী অ্যাম্বুল্যান্সটি পথে বিকল হয়ে পড়েছিল। আর তখন থেকে এই অভিযোগ জোরালো হয়। প্রচারমাধ্যমের কর্মীরা মাহারাজের প্রতিও নাখোশ। কারণ তিনিও ম্যান্ডেলার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার খবরটি নাকচ করে দিয়েছেন। সংবাদকর্মীদের ধারণা, আসলে মাহারাজও তাঁর সাবেক কমরেড ম্যান্ডেলার স্বাস্থ্য সংবাদ বিষয়ে বর্তমান প্রশাসনের চাপে কিংবা তাদের হয়ে তথ্য দিচ্ছেন। তবে যত চেষ্টাই করা হোক, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ নিজেদের প্রস্তুত করছে, তাদের সামনে বড় একটি দুঃসংবাদ আসছে। আর প্রচারমাধ্যমগুলো অপেক্ষা করছে, তাদের সংবাদ শিরোনামও করতে হবে ম্যান্ডেলাকে নিয়ে। আর এটা হতে পারে যেকোনো সময়।
লেখক : ডিক্ল্যান ওয়ালশ
২৬ জুন প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.