জিএসপি স্থগিত করল যুক্তরাষ্ট্র

তৈরি পোশাক কারখানার কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ বাজারসুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছে ওবামা প্রশাসন।
পোশাক খাতে কাজের পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এ স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দেড়টার দিকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানানো হয়। বার্তা সংস্থা এএফপি, রয়টার্স, এপি ও বিবিসি অনলাইনের খবরেও এ বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
মার্কিন বাণিজ্যবিষয়ক প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যান গতকাল ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এক আদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থগিত করা হলো। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে একের পর এক দুর্ঘটনা ও বিপর্যয়ের কারণে কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বারবার তাগিদ দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন।
মাইকেল ফ্রোম্যান বলেন, ‘সাম্প্রতিক কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনায় ফুটে উঠেছে যে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে কাজের নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে।’
জিএসপি সুবিধা স্থগিত প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামার ওই আদেশে বলা হয়, ‘আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে...উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত করাই শ্রেয়। কারণ, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকারের মানদণ্ড অনুযায়ী তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কিংবা নিচ্ছে না।’
যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিত হওয়ায় বাংলাদেশের বেশ কিছু পণ্য দেশটিতে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা হারাবে। তবে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক এ বাজারসুবিধা পায় না। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, শ্রমমানের উন্নয়নের জন্য দেওয়া শর্ত পূরণ করতে পারলে জিএসপি সুবিধা আবার ফিরে পাবে বাংলাদেশ।
এএফএল-সিআইওর সন্তোষ: আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনের (এএফএল-সিআইও) একটি আবেদনের ছয় বছরের বেশি সময় পর বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত হলো। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জিএসপি বাতিলের দাবি জানিয়েছিল সংস্থাটি।
এদিকে এএফএল-সিআইও বাংলাদেশের জিএসপি বাতিলের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে দেওয়া এক বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি রিচার্ড ট্রুমকা এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
রিচার্ড ট্রুমকা বলেন, জিএসপির ন্যূনতম শর্ত পূরণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে বাংলাদেশ সরকার গত ছয় বছরের বেশি সময় ব্যর্থ হয়েছে। বাণিজ্যসুবিধা কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে আমাদের বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোকে কঠিন এ বার্তাটি দেওয়া হবে—যে সুবিধা তারা ভোগ করবে, তার শর্তগুলো তাদের পূরণ করতে হবে। যে দেশগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশের পরিবর্তন আনবে না, শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, বিশেষ করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেবে না, যুক্তরাষ্ট্রে এসব দেশ অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা হারাবে।
এএফএল-সিআইওর সভাপতি এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন, কর্মপরিবেশের উন্নতি ঘটাতে পারলে বাংলাদেশ ফের জিএসপি সুবিধা ভোগ করবে। রিচার্ড ট্রুমকা বলেন, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও উন্নত কর্মপরিবেশের ব্যাপারে অঙ্গীকার পূরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে পারে।
জিএসপির প্রভাব: যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে এতে তেমন আর্থিক কোনো ক্ষতি হবে না; তবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সংকট তৈরি হবে। ওবামা প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) প্রভাবিত করতে পারে। কারণ, ইইউ শ্রমের মান নিয়ে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে। ইউরোপে জিএসপি সুবিধা বাতিল হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে।
তবে মার্কিন বাজারে জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে সরকার শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল।
২০০৭ সালের পিটিশন: শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তাজনিত শর্ত পূরণে ব্যর্থতার কারণে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের দাবি জানায় এএফএল-সিআইও। পোশাক কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, অবনতিশীল শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড (এক বছর পরও যার সুরাহা হয়নি) এবং তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের শেষ প্রান্তে এসে বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে পর্যালোচনার প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার হয়। শেষ পর্যন্ত ওবামা প্রশাসন এএফএল-সিআইওর পিটিশনটি গ্রহণ করে। আর গত এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।
রন কার্কের চিঠি: জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রন কার্ক ২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে রন কার্ক বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদনপত্রে বলা আছে, এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সব শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করছে না। বিশেষ করে, শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এসব ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছিল।
এর পরই চিঠিতে রন কার্ক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা বাতিল করার কথা বিবেচনা করছে, তা লেখেন। তিনি বলেছেন, শিগগিরই মার্কিন সরকার নিয়মানুযায়ী ফেডারেল রেজিস্ট্রারে (সরকারের গেজেট) নোটিশ জারি করবে। সেখানে ঘোষণা থাকবে, শ্রমিক অধিকারের বিষয়েই তারা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল বা স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছে। এ জন্য গণমতামত চাওয়া হবে। এর পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত কিছুদিন সময় পাবে বাংলাদেশ। সে কথা রন কার্ক চিঠিতেও লিখেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন খুব দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।’
জানতে চাইলে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্ত ইউরোপের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যাবে। কাজেই সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য যে চাপ তৈরি করবে, সেটিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার, বিজিএমইএ এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.