চারুশিল্প সৃজন উদ্যান by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

শিল্প কখনো কখনো আম জনতার সঙ্গে যুক্ত হয় মঞ্চ, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রদর্শিত শিল্পরূপসজ্জার সাহায্যে। একটি দেশের অগ্রগতি, রুচি ও মননসম্পন্ন মানুষ তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে গণমাধ্যম। হোক সে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম।
১৯৬৪ সালের ৫ ডিসেম্বর এই অঞ্চলে উন্মোচিত হলো টেলিভিশন সম্প্রচারের অধ্যায়। আজকের বিটিভিতে (সেসময়ের পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশনে) তখন দৃশ্যসজ্জা, অনুষ্ঠান শিল্পনির্দেশক হিসেবে যোগ দেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, ইমদাদ হোসেন, কেরামত মওলা প্রমুখ। তাঁদের শিল্পবোধ প্রয়োগে সাধারণ মানুষের কথা উঠে আসে। আবহমান বাংলার মুখচ্ছবি ফুটে ওঠে অনুষ্ঠান সমূহে প্রকাশ পায় অনুষ্ঠানসমূহে। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে এ শতকের শুরুর দশক পর্যন্ত অব্যাহতভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করেছেন ও এখনো কর্মরত আছেন। তাঁরা আয়োজন করেছেন ‘সৃজনের উদ্যান’ শিরোনামের একটি প্রদর্শনী। দুটি ভাস্কর্য, একটি স্থাপনাশিল্পসহ ৩৪ জন শিল্পীর মোট শিল্পকর্মের সংখ্যা ৬১টি। শিল্প উদ্যানের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, এ বাংলায় তা অব্যাহত আছে এখন অবধি। প্রকৃতিপাঠে মুস্তাফা মনোয়ার এখনো সমান মনোযোগী। এ প্রদর্শনীর ‘রিভার সাইড’ নদীর তীরকে বিষয় করে আঁকা। অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের এ ছবিতে শিল্পী আড়াআড়ি নীল রঙের তুলির আঁচড়ে নদীর প্রকৃত ছন্দ স্পষ্ট করেছেন। আনোয়ার হোসেন ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ প্রদর্শনীর কাজে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে শান্তির প্রতীক পায়রা ও রজনীগন্ধা ফুলের আদতে উপস্থিত করেছেন। যুদ্ধ, শান্তি ও ফুলেল সৌরভই শিল্পীর আকাঙ্ক্ষা।
মহিউদ্দিন ফারুকের বলিষ্ঠ ও লালিত্যময় রেখায় গড়ে উঠেছে নারীর দেহভঙ্গি। নারীর সঙ্গে প্রকৃতি যুক্ত করে একটি ছন্দের অবতারণা করেন মহিউদ্দিন। সাদা কাগজে কালিকলমে এ ছবির শিরোনাম ‘বনলতা সেন’। মূর্ত, বিমূর্ত, নিসর্গ, নদী আর চিরচেনা সবুজ—এসব শিল্পী ক্যানভাসে আনলেও জ্যামিতিকে হাজির করেছেন কোনো কোনো শিল্পী। রেজাউল করিমের মনোযোগ জ্যামিতি আর রঙের নির্দিষ্ট ব্যবহারে। তেলরংকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন তাঁর কাজে। চিত্রতল ও আঙ্গিক তৈরির পর সাদা রং ঢেলে দিয়ে আস্তর দিয়ে দেন। আবদুল মান্নানের প্রতিকৃতি নিয়ে আমাদের অবাক বা বিস্ময় জাগে। বাস্তবধর্মী রীতিতে আঁকা রবীন্দ্রনাথ আমাদের আপ্লুত করে। কবিগুরুর প্রতিকৃতির সঙ্গে পরিচিত পোশাকের ভাঁজে রেনেসাঁস সময়ের শিল্পীদের ধ্যান স্পষ্ট। মোহাম্মদ ইউনুস বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক হলেও আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ টেলিভিশনের শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর কাজের চেনা রূপ আমরা আবার ফিরে পেয়েছি ‘এভিডেন্স’ শিরোনামের কাজে। বিজয় সেনের কাজে কোমল রং আর বিষয়ে গতি আর দ্রোহের কথা বলে। হারুন আল রসিদের সাদা সিমেন্টে গড়া নারীর উদ্যত হাত তোলা ভাস্কর্য আকাঙ্ক্ষার কথা বলে দেয়। নৌকার সারি এঁকেছেন মানিক দে, শিরোনাম ‘জলের ছন্দ’। ছবিতে নৌকার বহর দেখা যায় সম্মুখ দিক থেকে, দূরে আকাশে হালকা মেঘের হাতছানি। ক্যানভাসে বুনট তৈরি করে তার ওপর তুলির ছোপ ছোপ রং প্রয়োগ করে বিষয় নির্মাণ করেছেন মানিক। ষাটের দশকের শুরুতে যে শিল্পবোধসম্পন্ন গণমানুষের অনুষ্ঠান নির্মাণ হয় তা অব্যাহতভাবে আরও আধুনিক মনোভাবনা যুক্ত হয়ে এগিয়েছে। এ প্রদর্শনীর শিল্পীদের কাজে এ প্রমাণ স্পষ্ট। কিছু দুর্বল বা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবহীন কাজের উপস্থিতি ছাড়া অন্যান্য কাজে দর্শক স্বস্তি পাবেন। সৃজনের উদ্যানে বেড়ে উঠুক সতেজ বৃক্ষ। ২৩ জুন শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হবে আগামী ৩ জুলাই।

No comments

Powered by Blogger.