সাবধান! তুরাগের পানি ব্যবহার করবেন না- পাহারা দিচ্ছে পুলিশ by শাহীন রহমান

বিশ্ব এজতেমা উপলৰে লাখ লাখ মুসলিস্ন এখন টঙ্গির তুরাগ নদীর তীরে জমায়েত হয়েছে। এজতেমায় আগত মুসলিস্নদের ওজু থেকে শুরম্ন করে রান্নাবান্না, গোসল ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করার একমাত্র উৎস ছিল তুরাগ নদীর পানি।
অথচ তুরাগের পানি এতই দূষিত হয়েছে যে তা ব্যবহার না করার জন্য র্যাব পুলিশের পাহারা বসানো হয়েছে। 'নদীর পানি ব্যবহার না করি' লিখে তুরাগ পারে বহু সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হয়েছে । এজতেমায় আগত দেশী বিদেশী মুসলিস্নদের নদীর পানি ব্যবহার না করার জন্য সতর্ক করার কারণ নদীর পানি অধিক মাত্রায় বিষাক্ত। কলকারখানার বর্জ্যে তুরাগ নদীর পানি ব্যবহারের উপযুক্ততা হারিয়েছে। এ কারণে তুরাগ নদীর দূষিত পানি মুসলিস্নদের ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক নোটিস জারি করা হয়। আলাদাভাবে ওজু ও গোসলের পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেখানে। মুসলিস্নদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে তারা যেন বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করেন। এজতেমায় আগত মুসলিস্নরা জানিয়েছে গতবারও তুরাগ নদীর পানি ওজু ও গোসলসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। অথচ এবার পানির অবস্থা দেখে তারা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর পানি কতটা দূষিত হলে এ ধরনের পদৰেপ নেয়া যায় তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বিশেষ করে মিঠা পানির প্রধান উৎস নদীর পানি যখন এভাবে দূষিত হয়ে যায় তখন বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্তি সীমিত হয়ে আসে। এ পানি ব্যবহারের বিরম্নদ্ধে পদৰেপ নেয়া না হলে উল্টো আগত মুসলিস্নরা বিপদে পড়ে যেত। তবে এজতেমার মাঠে বিষাক্ত পানি ব্যবহারের বিরম্নদ্ধে যে পদৰেপ নেয়া হয়েছে নদী দূষণরোধে যদি সরকার কঠোর পদৰেপ নিতে পারত তাহলে নদীর পানি এভাবে দূষিত হতো না। দূষণ রোধ করতে হলে দূষণকারীদের আগে দূর করতে হবে। এরপর বন্ধ করতে হবে দূষণ প্রক্রিয়া। তারপর পানি পরিশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য নতুন কোন আইনের প্রয়োজন নেই। অতীতে কোন সরকারকে নদী দূষণের বিরম্নদ্ধে পদৰেপ নিতে দেখা যায়নি। তাদের মতে, পরিবেশ সংরৰণ আইন ১৯৯৫ ও বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী সরকার নদ-নদীসহ পরিবেশের ভারসাম্য রৰা করতে পারে।
পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাত বলেন, পানি দূষণরোধে সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে তার সফলতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ যারা নদীর পানি দূষণ করছে তাদের বিরম্নদ্ধে এখন পর্যনত্ম কোন কার্যকর আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে দূষণ বা নদীতে বর্জ্য ফেলা এখনও বন্ধ হয়নি। তিনি বলেন, নদী দূষণরোধ করতে হলে প্রথমে দূষণকারীদের দূর করতে হবে। তারপর দূষণ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এরপর পানি শোধনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তার মতে এখন অনেকে দূষণরোধে নতুন আইনের কথা বলছে। কিন্তু পুরনো আইন কার্যকর করা গেলে নতুন কোন আইনের প্রয়োজন নেই। আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতর অনেক শক্তিশালী। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির উর্ধে উঠে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অবশ্যই নদী দূষণ রোধ করা সম্ভব। ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারের কঠোর পদৰেপের কারণে নদীগুলোকে দূষণরোধ করার নজির রয়েছে। এমনকি ভারত সরকার গঙ্গা নদী দূষণরোধে কঠোর পদৰেপ গ্রহণ করেছে। অথচ আমাদের দেশের এর কোনো নজির আজ পর্যনত্ম নেই।
দূষণের কারণে ঢাকার চার নদী এখন আবর্জনার ভাগারে পরিণত হয়েছে। এ নদীগুলো এখন দেখলে মনে হয় বিষাক্ত বর্জ্যে বড় ড্রেন। শিল্প বর্জ্য এবং আবাসিক বর্জ্যে মরতে বসেছে এসব নদী। এর ৬০ ভাগ দূষণ হচ্ছে শিল্প বর্জ্যে আর ৪০ ভাগ হচ্ছে পয়োনালীর বর্জ্যের মাধ্যমে। এসব নদীর পানি পরীৰা করে দেখা গেছে এ্যালুমিনিয়াম, ক্যাডমিয়াম, লেড, মার্কারি ও ক্রোমিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা পরীৰা করে দেখা গেছে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যনত্ম বুড়িগঙ্গায় এর মাত্রা শূন্য দশমিক ৫ এর নিচে। বর্ষার সময় এর পরিমাণ গড়ে ১ থেকে ২ মিলিগ্রাম। অথচ প্রতিলিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৮ মিলিগ্রামের ওপর থাকলে সে পানিই কেবল ব্যবহারের উপযোগী। ৫ মিলিগ্রামে নিচে থাকলে তা দূষিত পানি হিসেবে বিবেচিত হয়। ২ মিলিগ্রামের নিচে নেমে গেলে মাছসহ জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে না।
ঢাকা ও এর আশপাশে প্রায় ১০ হাজার গার্মেন্টস, ডায়িং, ওয়াশিং, পস্নাষ্টিক পলিথিন, চামরা কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার অধিকাংশই তরল বর্জ্যের পরিশোধনের কোন ব্যবস্থা নেই। এ কারখানাগুলো থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে বুড়িগঙ্গার উত্তরপাশে ঢাকার অংশে দুটি বড় খালসহ প্রায় ৩০ পাইপ রয়েছে যা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। দৰিণপারে কেরানীগঞ্জ থেকে সমপরিমাণ পাইপ দিয়ে বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদফতরের এক অভিযানে দেখা যায় এসব কারখানার কারও ছাড়পত্র নেই। এছাড়া বুড়িগঙ্গা থেকে প্রতিদিন ৪৯ টি রম্নটে প্রায় ২শ' লঞ্চ স্টিমার চলাচল করছে। এসব লঞ্চ স্টিমার থেকে প্রতিদিন টন টন রাসায়নিক নদীতে ফেলা হচ্ছে। হাজারীবাগে প্রায় ২৫০টি ট্যানারি শিল্প থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য মিশছে। রাজধানীর অভ্যনত্মর থেকে বড় কয়েকটি খালে সংযোগ রয়েছে সরাসরি বুড়িগঙ্গায়। এসব খাল দিয়ে নর্দমা সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গায়।
নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যনত্ম ৬০ মাইল বিসত্মৃত শীতলৰ্যার অবস্থাও একই। নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ থেকে নরসিংদীর ঘোড়াশাল পর্যনত্ম রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে প্রায় ৫শ'র ওপরে রয়েছে ডাইং কারখানা। যাদের কাজ মূলত ক্যামিকেলভিত্তিক। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে আসা বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, পরদ, কোরিন, নানা ধরনের এ্যাসিড, দসত্মা, সিসা, ফসফোজিপসাম। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের পোড়া মবিল, তেল, নদীর অংশ ও পাশের এলাকার বর্জ্য। লাখ লাখ টন তরল কঠিন বর্জ্য সু্যয়ারেজের লাইনে সংযুক্ত হওয়ায় পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ কম থাকায় এসব বর্জ্য নদীর তলদেশে গিয়ে মিশছে।
তুরাগ ও বালু নদীর পানিও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। পানিতে অতিমাত্রায় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কারণে মাছসহ জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৰীণ। বিশেষ করে তুরাগ নদীর পানি এতই বিষাক্ত যে এজতেমায় আগত মুসলিস্নদের ব্যবহার না করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে। এজন্য বসানো হয়ে পুলিশ পাহারা। দুর্গন্ধের কারণে বর্তমানে এর দু'তীর দিয়ে হাঁটা দায়। টঙ্গি বিসিক এলাকার বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য তুরাগ নদীতে মিশে পানির এই দশা হয়েছে। রাজধানীর উত্তরাংশে বালু নদী দূষণ চরমে পেঁৗছেছে। রামপুরা বাড্ডা এলাকার পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে লাইন দেয়া হয়েছে ত্রিমোহনী এলাকায় যা সরাসরি বালু নদীতে পড়ছে। এছাড়া গুলশান বারিধারার যাবতীয় আবর্জনা সু্যয়ারেজের লাইনের মাধ্যমে এ নদীতে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন থাকলেও অতীতে কোন সরকারই নদী দূষণের বিরম্নদ্ধে কোন পদৰেপ নেয়নি। যারা দূষণের সঙ্গে দায়ী তাদের বিরম্নদ্ধে আগে ব্যবস্থা নিতে পারলেই নদী দূষণমুক্ত করা যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এ ধরনের নজির আছে। বর্জ্য ফেলা বন্ধ না করে শুধু পরিশোধনের ব্যবস্থা করলে কখনও নদীর পানি দূষণরোধ করা যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.