মন খুলে বলছি- পরামর্শ দিচ্ছেন মোঃ জহির উদ্দিন, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী- সহকারী অধ্যাপক সাইকোথেরাপি বিভাগ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট- কারো মানসিক রোগ হলে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার কি করা উচিত?- _আশীষ রায়, মিরপুর।

মানসিক রোগ হলে মানসিক রোগের ডাক্তার (সাইকিয়াট্রিস্ট) দেখানো উচিত। রোগের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে। বেশীর ভাগ েেত্র ওষুধের পাশাপাশি মানসিক রোগীদের জন্য সাইকোথেরাপি প্রয়োজন হয়।
সাইকোথেরাপির অংশ হিসেবে রোগী নিজের সমস্যার কথা প্রাণ খুলে বলে হালকা হন। একপর্যায়ে মাথা ঠা-া করে নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করতে শুরম্ন করেন। উলেস্নখ্য আমাদের দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে মনোরোগবিদ্যা বিভাগে, পাবনা মানসিক হাসপাতালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগে এবং ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সস্টিটিউটে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়। রোগীর দায়িত্ব হচ্ছে চিকিৎসা নেয়া এবং চিকিৎসা বিধি মেনে চলা। এছাড়া মনে ভাল হওয়ার আশা রাখলে, ইতিবাচক চিনত্মা করলে, সামাজিক জীবন-যাপন করলে, আনন্দে থাকার চেষ্টা করলে এবং কর্মব্যসত্মতার মধ্যে থাকলে মানসিক রোগ কম থাকে।

আমার বয়স ৪২। সারাদিনে, বিশেষত বিকাল আর রাত্রিতে মৃতু্য চিনত্মা আসে। শরীর নার্ভাস হয়ে বুক ধরফড় করে, ঘন ঘন শ্বাস পড়ে এবং খুবই খারাপ লাগে। ডাক্তার পরীা করে কোন শারীরিক সমস্যা পায়নি। এর থেকে উত্তরণের পথ কি তা দয়া করে জানালে উপকৃত হবো।
-রফিক উদ্দিন, শাহ্বাগ, ঢাকা।

'প্যানিক ডিজঅর্ডার' নামে এক ধরণের মানসিক রোগে মানুষ মৃতু্য ভয়ে খুব কষ্ট পায়। এ ধরণের রোগী মনে করে যে সে নিশ্চিতভাবে মারা যাবে। তারা বিশ্বাস করে, তাদের গুরম্নতর নানা রকম শারীরিক রোগ হয়ে গেছে। কেউ মনে করতে পারে, তার মসত্মিষ্কে টিউমার হয়েছে, কেউ ভাবতে পারে যে তার হার্টের রোগ আছে। এই রোগীদের দিনে কয়েকবার করে মৃতু্যর সময়কার অনুভূতির মতো অনুভূতি হয়। তখন তাদের হাত-পা ঠা-া হয়ে আসে, শ্বাসকষ্ট হয়, অনেকে ঘন ঘন শ্বাস নেয়, বুক ধরফড় করে, খুব ঘাম হয়, মনের মধ্যে প্রচ- মৃতু্য ভয় হয়, বমি বমি লাগে, পেটের মধ্যে অস্বসত্মি হয়, মাথা ব্যথা করে। এছাড়াও এধরণের আরো নানা রকম উৎকণ্ঠামূলক লণ হতে পারে। এই রোগীরা স্বাভাবিক শারীরিক লণকে ভুল ব্যাখ্যা করে ভয় পেয়ে যায়। যেমন, একটু গ্যষ্ট্রিকের ব্যথা হলে মনে করে, এটা মৃতু্যর লণ। মাথা ব্যথা করলে মনে করে মাথায় খারাপ ধরণের টিউমার হয়েছে। ফলে উৎকণ্ঠা বেড়ে গিয়ে আরো লণ তৈরী হয়। ভয় পেয়ে গিয়ে অনেক রোগী দ্রম্নত শ্বাস নিতে থাকে। দেখা গেছে যে, প্রয়োজনের থেকে দ্রম্নত কিছুণ শ্বাস নিলে শরীরের রক্তের মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বনডাইঅক্সাইডের স্বাভাবিক ভারসাম্যটি বিঘি্নত হয়। ফলে বিভিন্ন ধরণের অস্বসত্মিকর লণ তৈরী হয়। রোগী তখন আরো ভয় পেয়ে যায়। অনেক রোগীর ব্যাথা সহ্য করার মতা কম থাকে। ফলে সামান্য লণেই তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। অনেক রোগী রোগের কারণে অনেক কিছু এড়িয়ে চলে। অতি সাবধানতা অবলম্বন করে। যেমন, অনেক রোগী দেশের বাড়িতে বেড়াতে যায় না কারণ সেখানে ডাক্তার পাওয়া যাবেনা। অনেক রোগী বাস ব্যবহার করেন না কারণ বাস তার কথা মতো চলাচল করবে না। তারা বরং অটোরিক্সা ব্যবহার করে কারণ এটিকে প্রয়োজনে সে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে। অনেকে লঞ্চ ব্যবাহার করেনা কারণ সে মনে করে সে ডুবে মারা যেতে পারে। এছাড়া লঞ্চের গতিবিধিও সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। অনেকে শারীরিক পরিশ্রম করেনা, এমনকি যৌন কাজ থেকেও বিরত থাকে। মনে করে হয়তো তার রোগের লণ বেড়ে গিয়ে সে মরেও যেতে পারে। অনেকে বিশেষ কিছু খাবারকে বিপদজনক মনে করে খায় না। যেমন, হয়তো ডাল বা মাংস খেলনা, হাসের ডিম খেলনা। মনে করলো না খাওয়ার মাধ্যমে সে স্বাস্থ্য ঝুকি কমাচ্ছে। অনেক রোগী অধিক সতর্কতা দেখায়। সাথে করে নিজের নাম ঠিকানা লিখে পকেটে রাখে যাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে বা মরে গেলে কেউ না কেউ পরিবারের সদস্যদের খবর দিতে পারে। অনেক রোগী বেশ ভাল পরিমাণ টাকা সাথে রাখে যাতে প্রয়োজনে হাসপতালে ভর্তি হওয়া যায়। অনেক রোগী সাথে বিশেষ ধরণের ওষুধ (মানসিক রোগের ওষুধ), খাবার এবং পানি রাখে। মনে করে এর মাধ্যমে সে নিজের উপর ঝুঁকি কমাচ্ছে। এদের মধ্যে নেতিবাচক চিনত্মা বিশেষতঃ খুব খারাপ কিছু ঘটবে এমন ধরণের উৎকন্ঠার চিনত্মা করার প্রবণতা বেশী। এদের অনেকে স্বাস্থ্য বিধি বা স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্যকে ভুল ব্যখ্যা করে ভয় পেয়ে যায়। মনে করে তার শরীরে নানা ধরণের রোগ হয়েছে। অনেকে ভয়ে ওষুধ ও খেতে চায় না। এই রোগীদের অনেকে আবার বিভিন্ন ধরণের প্রচুর টেস্ট করান, যেমন, ইসিজি, এক্সরে, সিটিস্ক্যান। এমনকি ডাক্তারকে অনুরোধ করে টেস্ট লিখিয়ে নেন। কিন্তু যখন ফল ভাল আসে তখন তা মানতে পারেন না। এদের অনেকে ঘন ঘন ডাক্তার বদলান। কোন ডাক্তারের উপর তার পূর্ণ আস্থা থাকে না। এই সমস্যার সমাধানের জন্য মনে সাহস বাড়াতে হবে। মানসিক রোগের ডাক্তার দেখানো যায়। মনে করতে হবে চিকিৎসক যে ওষুধ দিচ্ছেন তা ভালর জন্যই দিচ্ছেন। তার ওষুধ ও চিকিৎসা বিধান মেনে চলতে হবে। শরীরের লণ সহ্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই ধরণের রোগে মৃতু্য হয় না। কারো মাথায় নেতিবাচক চিনত্মা আসলে তার চেষ্টা করতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ চিনত্মা করতে। একটা চিনত্মা আসলে সাথে সাথে সেই চিনত্মাটা মেনে না নিয়ে ঐ চিনত্মার প েকোন যুক্তি আছে কিনা তা যাচাই করতে হবে। যদি একা একা নেতিবাচক চিনত্মা বাদ না দেয়া যায় তবে 'কগনেটিভ বিহেভিয়র থেরাপি' নামের একধরণের সাইকোথেরাপি দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ চিনত্মা করারা প্রশিণ দেয়া যায়। ভারসাম্যপূর্ণ চিনত্মার সময় ভাল ও মন্দ দুই দিক বিবেচনায় নিয়ে আমরা যুক্তিপূর্ণ চিনত্মা করি। ভারসাম্যপূর্ণ চিনত্মা করলে মৃতু্যভীতির লণগুলো কমে যাবে। এছাড়া রোগীকে স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য পড়া এবং তার ভুল ব্যাখ্যা করা বন্ধ করতে হবে। ভয়ের বশবর্তী হয়ে যেসব কাজ রোগী এড়িয়ে যাচ্ছেন সেগুলো এড়ানো চলবেনা। যেমন, যারা লঞ্চে উঠছেননা তাদের লঞ্চে উঠতে হবে। যারা দেশের বাড়ি যাওয়া এড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের উচিত দেশের বাড়ি যাওয়া। কোন ধরণের খাবার নিয়ন্ত্রণ করাও জরম্নরী নয়। ঘন ঘন বিনা প্রয়োজনে টেস্ট করানো বন্ধ করতে হবে। এছাড়া একটু খারাপ লাগলেই দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। নিজের ইচ্ছামতো ওষুধ গ্রহন করা বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ প্রেসক্রিপশন ছাড়া শুধু খারাপ লাগছে বলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। ঘন ঘন ডাক্তার এবং সাইকোলজিস্ট বদলানো যাবে না। রোগীকে অধিক সতর্কতা নেয়া বন্ধ করতে হবে। তাহলে সে বুঝতে পারবে যে, প্রকৃতপ েএতো সকর্ততা না নিলেও অসুবিধা হয়না। এভাবে সে ভাল হবার পথে একধাপ এগিয়ে যাবে। রোগীকে একা একা দূরের যাত্রায় যাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। যদি দমবন্ধ হয়ে আসা ইত্যাদি লণগুলো শুরম্ন হয় তবে মনে সাহস রাখতে হবে। খুব ভাল হয় তখন শরীরের দিকে মন না দিয়ে অন্য কোন সাধারণ বিষয়ে কারো সাথে গল্প শুরম্ন করতে পারলে। শরীরের দিকে, অর্থাৎ লণের দিকে গুরম্নত্ব না দিলে একটু পর লণগুলো এমনিতেই কমতে শুরম্ন করে। কিছুণ পরে একদম চলে যায়। যদি রোগী তার মাথায় এটুকু রাখতে পারে যে লণের ফলে খারাপ কিছু ঘটবে না তাহলে মৃতু্যভীতি রোগটি অনেক কমে যাবে। একসময় একদম ভাল হয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.