সমাজ ভাবনা-নারী ও মানবাধিকার by আফরোজা পারভীন

সচেতন অভিভাবকরা তাদের মেয়ে সন্তানদের সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সেসব সুযোগ যথাযথই কাজে লাগাচ্ছেন। সেদিন বেশি দূরে নয় যখন নারী নিজ গুণেই তার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেশ ও দশের কল্যাণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে। ঘোষিত নারীনীতির সফল বাস্তবায়ন নারীর তথা দেশের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে নিঃসন্দেহে


পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ও মানুষ সমার্থক নয়। নারী একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা, যা কোনো বিচারেই মানুষবোধক নয়। বরং নারী হলো অর্ধেক মানুষ বা বিকৃত মানুষ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষই হলো আসল মানুষ, আর সেই পুরুষের সুযোগ্য অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার জন্য নিদেনপক্ষে যেটুকু বৈশিষ্ট্য থাকলে পুরুষের জীবনযাপন নির্বিঘ্ন হয় ঠিক ততটুকু মানুষই একজন নারী। যুগে যুগে সেই বিকৃত মানুষ তথা নারীর গুণগান গেয়ে অথবা তার নিকৃষ্টতার বয়ান করে মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক ইত্যাকার 'শ্রেষ্ঠ মানুষেরা' তাদের শাস্ত্র, তত্ত্ব, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি দিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গোটা মানবজাতিকে প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছেন যে, নারী আসলে একজন সাধারণ মানুষ। ভুলিয়ে দিয়েছেন যে জন্মগতভাবে মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ উভয়েই স্বাধীন ও সমান। প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য, ধনী বা দরিদ্র সব দেশেই ধর্মের বিধিবিধান সেই ভ্রমকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্য হিসেবে, যে সত্যকে প্রশ্ন করলেই সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে নারীর মানুষ পরিচয়কে স্থায়ীভাবে মুছে দেওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছে। নারীকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে তার আচার-আচরণ, কর্মের ধরন ও পরিধি। নিরুপায় নারী তার জন্য নির্ধারিত আচার-আচরণ রপ্ত করে, নির্দিষ্ট পরিধিতে জীবনকে আবদ্ধ করে শুধুই বেঁচে থেকেছে। নারী তার জীবনের মানে খুঁজে ফিরেছে পুরুষের সন্তুষ্টিতে। তাই রাজা রামমোহন রায় চিতায় সতীদাহ বন্ধ করলেও সতীত্বের সংজ্ঞায় আজ অবধি কোনো পরিবর্তন আসেনি। বিদ্যাসাগর বিধবার সিঁথিতে সিঁদুর তুলে দিয়েছেন বটে, তথাপি বৈধব্যের স্বরূপ অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। নারী নারীই রয়ে গেছে। কেননা নারীর স্বীকৃত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার মানবাধিকার নয়। সুকৌশলে নারীকে বঞ্চিত করা হচ্ছে মানুষের মৌলিক পাঁচটি অধিকার থেকেই। নারী তার অন্নসংস্থানের জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়; নারীর বস্ত্র নির্দিষ্ট হয় অপরের যৌনাকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে; নারীর শিক্ষা উৎপাদনমুখী কাজে লাগানো হয় না; নারীর নিজের কোনো বাসস্থান নেই; সর্বোপরি নারীর অসুস্থতা কাম্য নয়, ফলে চিকিৎসা সহসা তার অধিকারে আসে না। এভাবে মৌলিক অধিকারবঞ্চিত পরনির্ভরশীল, পরাধীন নারী নারীই থেকে যায়, মানুষ বলে দাবিও করে না, পাছে অস্তিত্বে টান পড়ে। আশার কথা, শাস্ত্র, ধর্ম, দর্শন বা আইনে নারীর অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলেও সময়ের প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে নারী নিজেই ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির চাপে মানবসত্তাকে বিসর্জন দেওয়া নারীই পরিবর্তিত সময়ে অতি সঙ্গোপনে তার প্রায় বিস্মৃত মানবসত্তাকে চিনতে শুরু করেছে। নারী মানুষ বলেই সে মানুষ হয়ে উঠছে। তাই পর্দার চেয়ে ব্যক্তিত্বের ভূষণে আজকের নারীরা অনেক বেশি মর্যাদাবান, আত্মবিশ্বাসী ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
নারীর মানবাধিকার হরণ শুরু হয় মূলত তার ঘর থেকেই। স্বয়ং জন্মদাতা মা-বাবা তাকে বঞ্চিত করে তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে। ফলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিধান সংবিধানের ঘোষিত সমঅধিকারের ঘোষণার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটে চলেছে প্রতিটি ঘরে তথা দেশের অর্ধেক মানুষের ক্ষেত্রে। পরিতাপের বিষয়, দেশের সব ক্ষেত্রেই সাধারণ আইন প্রযোজ্য, কেবল সম্পত্তির ভাগাভাগির বেলায় ধর্মীয় বিধান প্রয়োগ করা হয়, যা সংবিধান স্বীকৃত সব মানুষের সমান অধিকারের পরিপন্থী। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সংবিধান তথা মানবাধিকারের এই লঙ্ঘন প্রতিটি মা-বাবাকেই বিচলিত করে, আহত করে। কারণ সন্তান বাৎসল্য তো কন্যা বা পুত্রভেদে কমবেশি হয় না। তথাপি পুরুষতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে সজ্ঞানেই কন্যাসন্তানের বলি দেন পুরুষতান্ত্রিক মা-বাবা। তবে এই চিরায়ত ধারায়ও আজকাল অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মা-বাবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের কন্যাসন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকারে সমতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন জীবদ্দশাতেই। অন্যদিকে সম্পদহীন নিঃস্ব মা-বাবা ছেলে-মেয়ের ভেদাভেদ আমলে নেন না পেটের তাগিদে, ধার ধারেন না পর্দার, কন্যা-পুত্র উভয়কে পাঠান উপার্জনমুখী কাজে। তাই দরিদ্র নারীই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মানুষরূপে প্রতীয়মান হয়। আশির দশক থেকে এ দেশে তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করতে আসা লাখ লাখ শ্রমিক নারীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকারহীনতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে। অসংখ্য নারীর কোদাল হাতে কামলা না খাটলে কিংবা হাতুড়ি দিয়ে ইট না ভাঙলে পেটে ভাত জুটবে না। এসব মানুষ নারীর সংজ্ঞা জানে না, সংবিধান বোঝে না, নারীনীতির নামও হয়তো শোনেনি, কিন্তু নিজগুণে তথাকথিত 'ঞযবড়ৎু ড়ভ ঝবঢ়ধৎধঃব উড়সধরহ' অথবা 'ঞযবড়ৎু ড়ভ ফরভভবৎবহঃ ভঁহপঃরড়হধষরঃু'-কে ভুল প্রমাণ করে চলেছে। নারী নয়, মানুষ হয়ে বাঁচার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এই মানুষরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অচলায়তন ভাঙতে পারে না, কারণ তারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন। এ কারণেই এই নারীদের নিয়ে আলেম-ওলামাদের মাথাব্যথা নেই, যত মাথাব্যথা খাঁটি নারীদের নিয়ে, যারা সমান অধিকার পেলে তাদের সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে, ক্ষমতায় ভাগ বসাবে। তাই বর্তমান সরকারের ঘোষিত নারীনীতি আলেমদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। নারীনীতির বিরুদ্ধে তাদের আস্টম্ফালন_ নারীনীতি নাকি নারীকে পুরুষ বানানোর প্রচেষ্টা। আমিনীরা জানেন না যে তাদের মতো পুরুষ এ দেশের কোনো নির্বোধও হতে চাইবে না।
বাহাত্তরে নারী তার মানবাধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বাধীন দেশে নারীর অধিকার সুরক্ষায় অনেক আইন প্রণীত হয়েছে। নারী নির্যাতন রোধে প্রণীত হয়েছে কঠোর আইন-কানুন। কিন্তু এসব আইন-কানুনের যথাযথ প্রয়োগ কখনোই হয়নি। ফলে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক বাস্তবতা নারীকে পদে পদে বঞ্চিত ও নির্যাতিত করে চলেছে। ষোলো কোটি মানুষের স্বাধীন দেশের আট কোটি মানুষই পরাধীন রয়ে গেছে। পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে_ দেশের অর্ধেক মানুুষকে নিষ্ক্রিয় রেখে এগোতে পারছে না দেশ, সুখ-সমৃদ্ধি থাকছে সুদূরপরাহত। বর্তমান সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যথার্থই অনুধাবন করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। ঘোষিত নারীনীতিতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতিফলন দেখা যায়। অপরপক্ষে যে মৌলবাদী ধর্মান্ধরা ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, আজ যথারীতি সেই অপশক্তিই নারীনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, কোরআন হাতে রাজপথে নেমেছে ফতোয়া বন্ধের বিরুদ্ধে।
একাত্তরে সাত কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি 'বড় আলেমরা'। সাড়ে তিন কোটি নারীর সঙ্গে সাড়ে তিন কোটি পুরুষ একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ সেই স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মের বিকৃত ও সংকীর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে উগ্রপন্থিরা ষোলো কোটি মানুষকে বোকা বানিয়ে তার আট কোটি নারীকে দাবিয়ে রাখতে পারবে, সেই চিন্তা কেবল ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের উর্বর মস্তিষ্কেই উদ্ভব হওয়া সম্ভব। তবে নারীনীতির বিরুদ্ধে তাদের সাম্প্রতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবলোকন করে নিজ অধিকার সম্পর্কে উদাসীন নারীদের মধ্যে যদি অন্তত এইটুকু উপলব্ধি তৈরি হয়ে থাকে যে, সব মানুষের সমান অধিকার কতটা গুরুত্বপূর্ণ তবেই আলেম-ওলামাদের হরতাল 'সার্থকতা' পাবে। তবে নারীনীতি বিরোধীরা আসলেই অন্ধ, তারা জানে না বাংলাদেশের জনগণ গোঁড়া নয়, ধর্মান্ধও নয় বরং অনেক আধুনিক ও প্রগতিশীল। নারীনীতির বিরুদ্ধে তথা দেশের অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যাওয়ার রুচি বা মানসিকতা মুষ্টিমেয় কিছু উগ্রপন্থি ছাড়া সাধারণ জনগণের নেই। তবে ওই উগ্রপন্থিদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সৎ সাহসও যে আমাদের নেই সেটা আমাদেরই চরম কাপুরুষতা অথবা স্বেচ্ছা-ব্যর্থতা।
সংবিধানের দেওয়া সমঅধিকার সমাজে বা রাষ্ট্রের সর্বত্র সর্বতোভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক, সেদিকে চেয়ে বসে নেই এ দেশের মেয়েরা। তারা এগিয়ে যাচ্ছে নীরবে-নিভৃতে। দেশের সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে সংসদ, অফিস-আদালত, হাট-বাজার, মাঠ-ময়দান সর্বত্র তাদের আত্মবিশ্বাসী পদচারণা লক্ষণীয়। হাজার বছরের বঞ্চনার স্বীকার মেয়েরা বোধকরি মানুষের মৌলিক শক্তির খোঁজ পেয়েছে_ তার মেধার সন্ধান পেয়েছে। আদিম ও বর্বর পুরুষতন্ত্র গায়ের জোরে নারীকে সম্পত্তির ভাগ না দিতে পারে, ঘরে আবদ্ধ করতে পারে, কিন্তু তার মেধার বিকাশ বন্ধ করতে পারে না। একবার মেধার বিকাশ ঘটলে মানুষ সব প্রতিবন্ধকতাই জয় করতে পারে, অসংখ্য নারী তা করছেও। আজকাল মা-বাবা তথা পরিবার-পরিজনের আন্তরিক উৎসাহে মেয়েরা পড়ালেখায় মনোনিবেশ করছে, মেধার বিকাশ ঘটাচ্ছে। প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়েও আজ ছাত্রছাত্রীর অনুপাত অনেক ক্ষেত্রেই সমান সমান, কোথাও ছাত্রীই বেশি। এ এক বিস্ময়কর চলমান আন্দোলন, যা নারীকে তার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে নিশ্চিত বিজয় এনে দেবে। কেননা জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই মানুষের অগ্রযাত্রা বা সাফল্য তার শারীরিক শক্তি বা লিঙ্গ দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় তার মেধা ও জ্ঞান দ্বারা। বর্তমান সরকার তার সীমিত সম্পদ নিয়েই মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য নানা সাহসী ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে। সচেতন অভিভাবকরা তাদের মেয়েসন্তানদের সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সেসব সুযোগ যথাযথই কাজে লাগাচ্ছেন। সেদিন বেশি দূরে নয় যখন নারী নিজগুণেই তার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেশ ও দশের কল্যাণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে। ঘোষিত নারীনীতির সফল বাস্তবায়ন নারীর তথা দেশের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে নিঃসন্দেহে।

ড. আফরোজা পারভীন : সহযোগী অধ্যাপক, স্থাপত্য ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.