জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা-শিক্ষার্থী বাড়ছে, কমছে ঝরে পড়া by নুরুল ইসলাম নাহিদ

গত ৪ নভেম্বর থেকে সারাদেশে স্কুল ও মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণীর পাঠ সমাপ্ত করে জাতীয় ভিত্তিতে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি)/ জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এই পরীক্ষায় অনুপস্থিতির সংখ্যা নিয়ে কতিপয় জাতীয় দৈনিক ও কয়েকটি টেলিভিশনে 'বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত' এবং 'এরা অনেকে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ে গেছে' বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।


কোনো কোনো সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়ও লেখা হয়েছে। টক শোতেও বিষয়টি এসেছে।
গত ৩১ অক্টোবর এই পরীক্ষা বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে সব তথ্য লিখিতভাবে দিয়েছি। যারা রিপোর্ট তৈরি করে প্রকাশ করেছেন, তারা ভালোভাবেই সব তথ্য জানেন। তবে কেউ কেউ সঠিক তথ্য প্রতিবেদনে না দেওয়ায় বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে।
আমার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধেও সম্পূূর্ণ অসত্য তথ্য দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমি তার প্রতিবাদ করি না। বরং সত্যিই এমন দোষ-ত্রুটি আমাদের আছে কি-না তা ভালো করে যাচাই করে দেখি। আমার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম থেকেই গণমাধ্যমের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়ে আসছি। সাংবাদিক ভাইবোন, সম্পাদক, কলাম লেখক, টিভি আলোচকরা আমাদের অনেক প্রশংসা করছেন এবং সমর্থন ও উৎসাহ দিয়ে আসছেন। আমি সব সময়ই বলে আসছি, এগুলো আমাদের জন্য প্রেরণাদায়ক। তাদের পরামর্শ আমাদের কাজে সহায়ক হয়। যারা আমাদের সমালোচনা করেন এবং ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেন, তারাও আমাদের উপকার করছেন। আমরা তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতেও তারা আমাদের এভাবে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন এবং ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেবেন। আমরা তা শুধরে নেব।
যে বিষয়টি এখানে বলতে চাচ্ছি তা হলো, জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় অনুপস্থিতির সংখ্যাকে 'ঝরে পড়ে গেছে' বলে প্রচার করে সবার কাছে ভুল তথ্য পেঁৗছে দেওয়া হচ্ছে এবং এজন্য যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা করা। একই সঙ্গে এ কথাও পরিষ্কার করে বলে রাখছি, অধিকাংশ সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া সঠিক তথ্য দিয়েছে।
কতিপয় পত্রিকায় শিরোনাম দেওয়া হয়েছে_ 'প্রথম দিনে অনুপস্থিত ৬৮ হাজার পরীক্ষার্থী'। কেউ কেউ রিপোর্টের ভেতরে 'এরা ঝরে পড়ে গেলো' বা 'শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেল' এভাবে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চেয়েছেন_ এই শিক্ষার্থীরা আর লেখাপড়া করতে পারবে না। একটি দৈনিকে শিরোনামই করা হয়েছে_ 'প্রথম দিনেই ঝরে গেল ৬৮ হাজার শিক্ষার্থী'। এমনকি একটি দৈনিক প্রথম দিনের অনুপস্থিত সংখ্যা ও দ্বিতীয় দিনের অনুপস্থিত সংখ্যা যোগ করে শিরোনাম দিয়েছে 'জেএসসি-জেডিসিতে দুই দিনে অনুপস্থিত এক লাখ ১৪ হাজার শিক্ষার্থী'। সব জাতীয় পরীক্ষার দিন সন্ধ্যার মধ্যে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকে ওই দিনের পরীক্ষার যাবতীয় তথ্য মিডিয়া ও সংশ্লিষ্টদের সরবরাহ করে থাকি। এটা গোপন কিছু নয়, বরং দিনের শেষে সম্ভাব্য সব তথ্যই প্রকাশ করি।
আপাতদৃষ্টিতে অনুপস্থিতির সংখ্যা বেশ বড়ই মনে হয়। মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে দেড় লক্ষাধিক বিশেষ পরীক্ষার্থীর প্রতিদিন পরীক্ষা নেই। প্রতিটি পরীক্ষায় তারা অংশগ্রহণও করবে না। এক-দুই-তিন বিষয়ের মধ্যে যার যেদিন পরীক্ষা আছে, সেদিনই পরীক্ষা দেবে। এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে যদি কেউ 'এরা ঝরে পড়ে গেল' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এবং প্রকৃত তথ্য যাচাই না করে সেই প্রতিবেদনকে ভিত্তি করে কেউ কেউ যদি সম্পাদকীয় বা উপ-সম্পাদকীয় লেখেন, তা হলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। আমি দেশ, সমাজ ও দরিদ্র পরিবারগুলোর বাস্তবতা বিবেচনা করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, আমাদের ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতার জন্য আমাকে শাস্তি দিন। কিন্তু আমাদের সন্তানদের (শিক্ষার্থীদের) নিরুৎসাহিত ও হতাশ করবেন না। সবার কাছে এ আমার বিনীত অনুরোধ।
প্রকৃত চিত্র সবার অবগতির জন্য সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এ বছর জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯ লাখ ৮ হাজার ৩৬৫। এর মধ্যে জেএসসি ১৫ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭৫, জেডিসি ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯০ জন। সব মিলে ছাত্র ৪৭% এবং ছাত্রী-৫৩%। অর্থাৎ জেএসসি-জেডিসি মিলে ছাত্র সংখ্যা ৮,৯৬,৮৬২ এবং ছাত্রী ১০,১১,৫০৩ জন। ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রী সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৪১ জন বেশি। এই পরীক্ষা চালুর পর ২০১০ সাল থেকে এবার ২০১২ সালে তিন বছরে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ লাখ ১৫ হাজার ৫৬৩ জন। শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে না বরং বাড়ছে_ এ তথ্য সেটা প্রমাণ করে।
জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো ঝরে পড়া কমিয়ে আনা এবং এক পর্যায়ে তা বন্ধ করা। ঝরে পড়া এখন প্রতি বছরই কমছে, শিক্ষার্থীও বাড়ছে। তাছাড়া এই পরীক্ষা শিক্ষার মান বৃদ্ধি, সারাদেশে সমমান অর্জন, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠাসহ নতুন প্রজন্মকে শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত করছে।
পরীক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে এবং শিক্ষাজীবন অব্যাহত থাকে, সেজন্য আমরা যথাসাধ্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। এর মধ্যে অন্যতম হলো, যারা পরীক্ষায় ফেল করে বা অন্য কারণে শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখতে পারে না, তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানোর জন্য আমরা আগ্রহী করে তুলি। তাদের সমস্যা যথাসাধ্য দূর করে আবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণে নিয়ে আসি। এদের বলা হয় 'অনিয়মিত পরীক্ষার্থী'। এবার অনিয়মিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হলো ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৮৪ জন। এরা আগে ফেল করেছে অথবা ঝরে পড়েছিল। তাদের এবারে পরীক্ষায় নিয়ে আসা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, গত বছর যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের মধ্যে অনেকে এক, দুই বা তিন বিষয়ে ফেল করেছে। ফেল করার কারণে তারা যাতে কোনোভাবে ঝরে না পড়ে এবং শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখে, সে জন্য আমরা তাদের নবম শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ দিয়েছি। এ বছরের পরীক্ষায় তাদের ফেল করা (এক, দুই, তিন) বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করলেই চলবে। এ রকম পরীক্ষার্থীর নাম দেওয়া হয়েছে 'বিশেষ পরীক্ষার্থী'। এ রকম বিশেষ পরীক্ষার্থী এবার পরীক্ষা দিচ্ছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ১২ জন। স্বাভাবিকভাবেই এদের পরীক্ষা প্রতিদিন থাকবে না। কারও এক, কারও দুই বা কারও তিন দিন। ফেল করা স্ব স্ব বিষয়েই তারা পরীক্ষা দেবে, অন্য দিনগুলোতে কেন্দ্রে অনুপস্থিত থাকবে।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, প্রথম দিন অনুপস্থিত ৬৮ হাজার ১৫৫ জন, পরের দিন তা কমে হয়েছে ৪৬ হাজার ৩৪০ জন। অর্থাৎ প্রথম দিনে যারা অনুপস্থিত ছিল, দ্বিতীয় দিন তাদের মধ্য থেকে ২১ হাজার ৮১৫ জন উপস্থিত হয়েছিল। এভাবে তৃতীয় দিন, চতুর্থ দিন প্রথম দিনের চেয়ে ২০ হাজারের বেশি উপস্থিতি বেড়েছে। সুতরাং প্রথম দিনের পরীক্ষায় যারা অনুপস্থিত ছিল, তারা একেবারেই লেখাপড়া ছেড়ে চলে গেল অথবা ঝরে পড়ে গেল_ এ রকম সিদ্ধান্তে পেঁৗছানো যুক্তিযুক্ত নয়।
এ কারণেই 'বিশেষ পরীক্ষার্থীর' মধ্য থেকে অর্থাৎ ১ লাখ ৫৭ হাজার ১২ জন পরীক্ষার্থী সর্বোচ্চ তিন দিন ছাড়া অন্যান্য দিন অনুপস্থিত থাকবেই। কেউ একদিনই পরীক্ষা দেবে, বাকি সব পরীক্ষার দিন অনুপস্থিত থাকবে। তাই অনুপস্থিতির সংখ্যা দেখে ঢালাও অনুপস্থিত বলা যুক্তিযুক্ত হবে না। এমন যারা 'ঝরে পড়ে গেছে' বলে চিত্র তুলে ধরছেন, তাও সুবিচার করা নয়।
তাছাড়া যারা অনিয়মিত পরীক্ষার্থী (১,৭২,৬৮৪ জন), তারাও বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে আবার পরীক্ষা দিতে এসেছে। তাদেরও কারও কারও বাস্তব কারণে অনুপস্থিত থাকার আশঙ্কা থাকতে পারে। এমনকি নিয়মিত ছাত্রদের মধ্যেও অনুপস্থিত থাকতে পারে। যে কোনো পরীক্ষায়ই কিছু পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। আমরা সব শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসছি। ধরে রাখা বা ঝরে পড়া ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিন বছর পূর্বে যেখানে ৫ম শ্রেণীর আগেই ৪৮%, মাধ্যমিকে ৪২% ঝরে পড়ত (ভর্তিও হতো অনেক কম), এখন তা অর্ধেকের বেশি কমে এসেছে। ঝরে পড়া নতুন বিষয় নয় বা শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়। অতীতে ভর্তি, ঝরে পড়া, পরীক্ষা, ফলাফল_ এসবের তো কোনো খবরই রাখা হতো না। এখন এসব ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন এনেছি। তারপরও শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক বড় বড় কাজ বাকি আছে। আপনারা আমাদের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেবেন। সঠিক তথ্য দিয়ে সমালোচনা করে গঠনমূলক প্রস্তাব দেবেন। আমরা সব সময়ই তা সাদরে গ্রহণ করছি এবং করব। আমরা সবার সাহায্য-সহযোগিতাপ্রার্থী।

নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি :শিক্ষামন্ত্রী

No comments

Powered by Blogger.