আদিখ্যেতা by মেসবাহউদ্দীন আহমেদ

আমার কাছে কিছু কিছু বিষয় বিস্ময় লাগে। কেউ বলতে পারেন ব্যতিক্রম। দুটো অনুভূতিই ঠিক। মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি-আচারই তো কাজে-প্রকাশে প্রস্টম্ফুটিত হয়। সমাজের দর্পণও বলতে পারেন। পাঠক, আপনি হয়তো এই বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছেন, ওই সব বিষয়ে আপনার ভালো-মন্দ অভিমতও আছে। দেখুন তো, আমার মতো আপনার মনে এসব বিষয়ে প্রশ্নের উদয় হয়েছে কি-না।


১. নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়ে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহর ব্যানার-ফেস্টুুনে ছেয়ে গেছে অনেক দিন থেকেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের অফিসের কাছে। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অফিসের কাছে। এসব ব্যানার-ফেস্টুনের বক্তব্য : স্বাগতম, শুভেচ্ছা, মুক্তি চাই, মামলা তুলে নাও ইত্যাদি। শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে ওমুক ভাইকে নগর ছাত্র সংগঠনের ওমুক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত করায় দলের নেত্রীকে। কে জানাচ্ছে? ছাত্র সংগঠনের কয়েক জন সদস্য। যারা জানাচ্ছে তাদের ছবি তো আছেই। যারা প্রচার করছে তাদের ছবি, সৌজন্যে দু'একজন থাকতে হবে এবং তাদের ছবি বড় করে। যার জন্য করা হয়েছে তার ছবি ও দলের প্রধান নেতা-নেত্রীর ছবি। আত্মপ্রচারে বিকারগ্রস্ত মানুষ নগরের সৌন্দর্যহানি করে আশপাশের দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঢেকে দিয়ে এসব ডিজিটাল ব্যানার লাগাচ্ছে। এখন তো ব্যানার তৈরি করা সহজ। টাকা থাকলেই ডিজিটাল ব্যানার করা যায়। আগের মতো নিজেদের লিখতে হয় না বা শিল্পী দিয়ে লেখাতে হয় না।
গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে দেখেছি মিরপুর থেকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত সাংসদকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সারি সারি হোর্ডিং। সঙ্গে সাংসদের নেত্রীর নামও আছে। মনে হয়, যেন বিজয় দিবসটি এসেছে ওই সাংসদের কল্যাণে। তাকেই শ্রদ্ধা জানাতে সবাই সাভারে যাচ্ছে। আমরা এখন এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত বা বিরক্ত হলেও গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এক সাংবাদিকের কাছে বিজয় দিবসে এসব হোর্ডিং বিসদৃশ্য লেগেছিল। তিনি ফোন করলেন সাংসদকে এবং এ বিষয়টির জন্য তাকে প্রশ্ন করতেই তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে চিৎকার করে উত্তর দিলেন_ আপনার অসুবিধা কী? আমার লোকজন আছে, তারা করেছে। অন্যদের শক্তি-সামর্থ্য থাকলে তারা করুক।
২. আমাদের দেশে যত প্রেস ক্লাব আছে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আছে কি? জেলা শহরগুলোতে এখন প্রেস ক্লাব সীমাবদ্ধ নেই। থানাগুলোতেও প্রসারিত হচ্ছে। কোথাও আবার একাধিক। বিদেশ গেলে লক্ষ্য করার চেষ্টা করি, খোঁজ নিয়েও কোথাও পাইনি এ রকম।
৩. প্রেস-কার্ড এখন যথেষ্ট নয়। গাড়িতে প্রেস লেখা থাকতে হবে। এক সময় হরতাল-ধর্মঘটের সময় ভাংচুর এড়াতে প্রেসের একটা স্টিকার সাঁটানো হতো গাড়িতে। এখন সব সময়ই স্থায়ীভাবে লেখা থাকে 'প্রেস'। পত্র-পত্রিকার নাম থাকলে না হয় ভিন্ন বিষয় হতো। শুধু প্রেস। ইদানীং লক্ষ্য করছি আইনজীবী স্টিকার লাগানো গাড়ি। দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছেই। আবার কিছু গাড়ি জরুরি কাজে নিয়োজিত। প্রেস, আইনজীবী বা জরুরি কাজে নিয়োজিত গাড়ি কি পৃথক ট্রাফিক রুলসে পড়ে? পড়ে না। তবে কেন? একটি উত্তর সেদিন পেয়েছি। খাদ্য বিভাগের জরুরি কাজে নিয়োজিত লেখা দুটি গাড়ি ফেনসিডিল বহন করার সময় পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। 'পুলিশ' লেখা গাড়ি ছিনতাই কাজে ব্যবহার হয় দেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যক্তিগত গাড়িতে পুলিশ লেখা নিষিদ্ধ করেছিল।
৪. মৃত ব্যক্তির জন্মদিনে তাকে স্মরণ করা হয় নানা অনুষ্ঠানে। স্মরণসভা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। কিন্তু মৃত ব্যক্তির জন্মদিনে কেক কাটা হয়_ আগে কখনও শুনিনি; দেখিনিও। জিয়ার জন্ম দিবসে কেক কাটা শুরু হলো। গত বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেও দু'এক জায়গায় কেক কাটার খবর পত্রিকায় পড়েছি। পাঠক, আপনারা যারা বিদেশে থাকেন, যেখানে জন্মদিনে কেক কাটার রেওয়াজ, সেখানেও কি মৃত ব্যক্তির জন্মদিনে কেক কাটা হয়? আমার জানামতে নেই।
৫. প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা নন, এখন সাংসদদের জন্য সিংহাসনের মতো বড় চেয়ার প্রয়োজন। সেটা সরকারি কাজে হোক (প্রটোকলের অন্তর্ভুক্ত কি-না জানা নেই) বা রাজনৈতিক-সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা এলে সে ব্যবস্থা রাখতে হয়। আগে তো এটা কখনও দেখিনি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে, সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠানের খাবার খেতেন না। একটু-আধটু মুখে দিতেন সবার মতো একই কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারে বসেই। এই সেদিন ছবিতে দেখলাম, মমতা ব্যানার্জি সবার সঙ্গে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আলোচনা শুনছেন (মঞ্চেও নয়)। মনমোহন সিং ও সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের সভায় সবার সঙ্গে একই ধরনের চেয়ারে বসে মিটিং করেন। কই, তারা যে অন্যদের চেয়ে পৃথক_ তা বোঝানোর জন্য ভিন্ন চেয়ারের প্রয়োজন পড়ে না।


মেসবাহউদ্দীন আহমেদ : জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি ও অঙ্কুর প্রকাশনীর পরিচালক
mesbaha@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.