অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ by ইফতেখার আহমেদ টিপু

অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা কিছুতেই কাটছে না। সঞ্চয়, বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি দেশবাসীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট ও ব্যাংক ঋণের অভাবে দেশের শিল্প খাতে চলছে ত্রিশঙ্কু অবস্থা। বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র অনুজ্জ্বল হওয়ার পেছনে বহু কারণ থাকলেও অন্যতম হলো গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটসহ অবকাঠামোগত নানা রকম প্রতিবন্ধকতা।


গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট প্রকট হওয়ায় দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়ছে আমদানিনির্ভর এবং ক্রমেই তা স্ফীত হচ্ছে। আমদানিনির্ভরতা দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের শিল্প-কারখানাসহ উৎপাদনসংশ্লিষ্ট সব খাতেই পড়ছে বিরূপ প্রভাব। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হচ্ছে বাধা। অন্যদিকে শিল্প-কারখানাসহ উৎপাদনসংশ্লিষ্ট খাতগুলোর বিস্তৃতকরণ-প্রক্রিয়াও থেমে আছে। ফলে পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় শিল্প-কারখানা।
ব্যাংক ঋণের জন্য ব্যবসায়ীরা উচ্চ সুদ দিতে বাধ্য হওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের উৎপাদন খরচ। ব্যবসায়ীদের মুনাফা নিয়েও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চীনের পরই এখন বাংলাদেশের স্থান। বিশ্বের রপ্তানি বাণিজ্যে দুই দেশের পার্থক্য আকাশ-পাতাল হলেও তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। খোদ চীনের বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে তাঁদের কারখানা স্থাপনের কথা ভাবছেন। সস্তা শ্রমের জন্য বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। মানসম্মত পোশাক রপ্তানি করে আয় দ্বিগুণও বাড়ানো সম্ভব- এমন কথাই বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যবসায়ীরাও এ বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছেন বলে মনে হয়। আশার কথা, দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আসছে, যা একটি সুখকর খবর হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। তবে হতাশার খবর হলো- তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১ নম্বরে যাওয়ার জন্য এ খাতে নিত্যনতুন বিনিয়োগের অপরিহার্যতা থাকলেও দুই বছর ধরে সে ক্ষেত্রে স্থবিরতা চলছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই বছর ধরে তৈরি পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগ কার্যত বন্ধ। সব ধরনের প্রস্তুতি সত্ত্বেও গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে গত চার বছরে ৫২টি নতুন পোশাক কারখানা উৎপাদনে যেতে পারেনি। অযুত সম্ভাবনা সত্ত্বেও উদ্যোক্তারা তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। সরকারি হিসাবে দেশে ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ পরিমাণ বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় আসার সময়ের প্রায় দ্বিগুণ। তার পরও লোডশেডিং কমছে না। কল-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলে গ্যাস উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে দাবি করা হয়। তার পরও গ্যাসের হাহাকার লেগেই আছে। শিল্পোৎপাদনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। রাজধানীর অনেক এলাকায় গ্যাসের অভাবে রান্নাবান্না করা দায় হয়ে দাঁড়ায়। গ্যাসের অভাবে শিল্প-কলকারখানায়ও সংকট দেখা দিচ্ছে। বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র এ কারণে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সই এখন দেশের অর্থনীতির একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে, যার কারণে অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটছে না।
সীমিত আয়ের এই দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণের কাছে তা সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নির্ণয়ের সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। অপ্রিয় হলেও অর্থনীতিকে তার নিজের পথেই চলতে দেওয়া উচিত। বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। রপ্তানির নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি না হলে রপ্তানি আয় মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। বিশ্বমন্দা বাংলাদেশকে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ফেলেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচামাল ও শ্রমমূল্য বাড়লেও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দামে পণ্য বিক্রি করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। প্রবাসীদের আয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া অর্থনীতির জন্য একমাত্র সুসংবাদ বলে বিবেচিত হলেও সেখানে শঙ্কা কম নয়। দেশের শ্রমবাজার যেভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে, তাকে অশনিসংকেত বলাই যথার্থ হবে। এ বিষয়ে এখনই সাবধান না হলে দেশকে বড় ধরনের খেসারতই দিতে হবে।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ।
chairman@ifadgroup

No comments

Powered by Blogger.