বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৬৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, বীর বিক্রম দক্ষ ও সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে ১৩-১৪ এপ্রিল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম সহযোদ্ধাদের নিয়ে আশুগঞ্জে (রিয়ার) প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন।


তখন পর্যন্ত আশুগঞ্জ মুক্ত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশুগঞ্জ দখলের জন্য ১৩ এপ্রিল সড়কপথে পার্শ্ববর্তী ভৈরবে উপস্থিত হয়। পরদিন আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পেছনে হেলিকপ্টারে কমান্ডো ব্যাটালিয়নের প্রায় এক কোম্পানি সেনা নামে। গানবোট ও অ্যাসল্ট ক্রাফটের সাহায্যে নদীপথেও সেনা আসে।
১৪ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কয়েকটি জঙ্গি বিমান আশুগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আকাশ থেকে ব্যাপক গোলাগুলি করে। এর ছত্রচ্ছায়ায় দুপুর ১২টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল (কমান্ডো) হেলিকপ্টারে করে নাসিমের প্রতিরক্ষা অবস্থানের পেছনে (সোহাগপুর) অবতরণ করে।
আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম এতে দমে যাননি। অব্যাহত বিমান হামলার মধ্যেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থান পুনর্বিন্যাস করেন। এর পর দ্রুত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের আক্রমণের ধারা ও অবস্থান চিহ্নিত করে সহযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের মুখোমুখি হন। প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
নাসিম সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিক্রমের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলকে মোকাবিলা করেন। তাঁর সহযোদ্ধাদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় কমান্ডোরা কিছুটা পিছু হটে। তবে পাকিস্তানিরা ছিল যথেষ্ট বেপরোয়া। জীবনের মায়া ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আবার সংগঠিত হয়ে নাসিমের দলকে পাল্টা আক্রমণ করে। চার ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। কোনো স্থানে প্রায় হাতাহাতি যুদ্ধ হয়।
একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের দলকে প্রায় ঘেরাও করে ফেলে। তাঁরা প্রায় জীবনসন্ধিক্ষণে পড়েন। তখন তাঁর সহযোদ্ধাদের বেশির ভাগ আহত এবং কয়েকজন শহীদ। তিনি নিজেও আহত। এ অবস্থায় নাসিমের সামনে পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। শহীদদের মরদেহ সমাহিত করার ব্যবস্থা করে রাতের অন্ধকারে তিনি সহযোদ্ধাদের (আহতসহ) নিয়ে সরাইলের দিকে পশ্চাদপসরণ করেন।
আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। ২৫ মার্চের পর মেজর কে এম সফিউল্লাহর (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান) নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে নাসিমের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখন তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন।
প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর নাসিম প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের পঞ্চবটি সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘এস’ ফোর্সের অধীন ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। আশুগঞ্জ, মনতলা, মাধবপুর, শাহবাজপুর ও চান্দুরার যুদ্ধ তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম চান্দুরায় পুনরায় আহত হন। ৫ ডিসেম্বরের পর তিনি তাঁর দল (ব্যাটালিয়ন) নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হন। তাঁর দলের একাংশ (ব্রাভো কোম্পানি) চান্দুরার উত্তরে সিলেটগামী মহাসড়কে রোডব্লক এবং চান্দুরা-সরাইলের মাঝের এলাকা শত্রুমুক্ত করে। এর পর তিনি দলের অপর অংশ নিয়ে দ্রুত সামনে অগ্রসর হন।
৬ ডিসেম্বর তাঁরা ইসলামপুর যাওয়ার পর একটি দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে হঠাৎ হাজির হয় এক দল পাকিস্তানি সেনা। এর পর সেখানে যুদ্ধ হয়। তখন দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং তিনিসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ নিহত ও ১৪ জন বন্দী হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২।
আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও চাকরিচ্যুত হন।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার চাঁদপুর গ্রামে (ডাক ভাতশালা)। স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকার মহাখালী ডিওএইচএসে (বাসা ১৫৪, লেন ৪, ইস্টার্ন রোড)। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ ইদ্রিস, মা চেমন আরা বেগম। স্ত্রী সৈয়দা ইসমাত নাসিম। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.