সেই ফজলুর রহমান-ঋণ পুনঃ তফসিলে জনতা ব্যাংকের নতুন রেকর্ড by মনজুর আহমেদ

একসময় ব্যাংক খাতের আলোচিত ঋণখেলাপি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান। সেই ফজলুর রহমান রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক থেকে ১৩ বারের মতো তাঁর একটি ঋণ পুনঃ তফসিল করে নতুন রেকর্ড করেছেন।
ফজলুর রহমান একসময় সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন।


বিভিন্ন সময়ে সরকারের ডজন খানেক মন্ত্রী ও সাংসদের সুপারিশে রহমান গ্রুপের বিভিন্ন ঋণ বারবার পুনঃ তফসিল হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০১ সালের শেষ দিকে এসে কয়েকটি বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণে গুরুতর অনিয়মের কথা উল্লেখ করে। এর মধ্যে রহমান গ্রুপের ঋণ পুনঃ তফসিল করতে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি লাগবে’ এমন শর্ত জুড়ে দেয়। পরবর্তী বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজনৈতিক চাপে সেই শর্ত প্রত্যাহারও করে নিয়েছিল।
এ দফায় ফজলুর রহমান নিটিং অ্যান্ড ইয়ার্ন প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির ২১ কোটি ৭৩ লাখ ২৯ হাজার টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ পুনঃ তফসিল করেছে জনতা ব্যাংক। এ নিয়ে বিধিবহির্ভূতভাবে ১৩ বারের মতো ঋণটি পুনঃ তফসিল করা হলো। খেলাপি হিসাবে শ্রেণীকরণের আগেই পুনঃ তফসিল করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে।
ঋণটি পুনঃ তফসিল করার পরও টাকা আদায় না হওয়ায় এর স্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সূত্র জানায়। সর্বশেষ ২০১১ সালের শেষে ঋণের স্থিতি ছিল ২৩ কোটি ২০ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এই ঋণটি পুনঃ তফসিল করতে জনতা ব্যাংক কোনো এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট) নেয়নি। অথচ জনতা ব্যাংকের নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সাল থেকে বন্ধ হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের পরিদর্শনেও দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘ব্যবসা নেই এমন বন্ধ প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দীর্ঘদিনের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ পুনঃ তফসিলের প্রাক্কালে ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য বিবেচনা করা হয়নি।’
যোগাযোগ করা হলে ফজলুর রহমান দাবি করেছেন, তাঁর কারখানা চালু আছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি ১৩ বার ঋণ পুনঃ তফসিল করিনি। এই শিল্পটির ব্যবস্থাপনায় ছিল আমার ছোট ভাই। সে ১১ বার পুনঃ তফসিল করে থাকতে পারে। আমি মাত্র দুবার পুনঃ তফসিল করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি ব্যাংকের দায় পরিশোধ করে যাচ্ছি। দুই দিন আগে ৫০ লাখ ১৪ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি। আজ সোমবার আরও কিছু টাকা দেব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পুনঃ তফসিলের নীতিমালায় বলা আছে, পুনঃ তফসিল হবে নিম্নতম বাস্তব সময়ের জন্য। কিন্তু জনতা ব্যাংকের এই ঋণ পুনঃ তফসিল বাস্তব সময়ের জন্য হয়নি বলে সূত্র জানায়। ঋণটির প্রথম কিস্তি আদায়ে ‘গ্রেস প্রিরিয়ড’ বা সময় ছাড় দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে গ্রেস প্রিরিয়ড দেওয়া হয় নতুন প্রকল্পের ঋণ বিতরণের জন্য। কেননা, প্রকল্প স্থাপন শেষে উৎপাদন করে তা বাজারজাত করতে সময়ের প্রয়োজন হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা হচ্ছে, ঋণগ্রহীতা স্বভাবগতভাবে ঋণখেলাপি হলে ব্যাংক পুনঃ তফসিল আবেদন বিবেচনা করবে না। বরং এরূপ ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ আদায়ে যাবতীয় আইনি কার্যক্রম নেবে। পুনঃ তফসিলের সময় এ নির্দেশনার লঙ্ঘন হয়েছে বলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ঋণের জামানত অপর্যাপ্ত। মেয়াদোত্তীর্ণ ২৩ কোটি ২০ লাখ ৩৮ হাজার টাকার বিপরীতে জামানত হিসাবে প্রকল্পের পরিসম্পদের মোট মূল্য ১৩ কোটি ৩৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। যার মধ্যে প্রকল্পের জমির মূল্য মাত্র দুই কোটি ২৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অবচয় ছাড়াও বন্ধ প্রকল্পে দীর্ঘদিন পূর্বে স্থাপিত পুরাতন যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোর মূল্য বর্তমানে আর ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। সে হিসাবে ২৩ কোটি ২০ লাখ ৩৮ হাজার টাকার ঋণের বিপরীতে জামানতের মূল্য দাঁড়ায় মাত্র দুই কোটি ২৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ‘ঋণটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’। তা সত্ত্বেও ২০১১ সালে মে মাসে ঋণটি পুনঃ তফসিলের সময় গ্রাহকের অনুকূলে নয় লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের ঋণপত্র বা এলসি খোলা এবং এক কোটি টাকার অতিরিক্ত সিসি বা নগদ ঋণসীমার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক খাতে আরও ঋণ: এক ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্যভান্ডার বা সিআইবি প্রতিবেদন অনুসারে ছয় ব্যাংকের ফজলুর রহমানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের স্থিতি হচ্ছে ৩৬৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। যদিও ফজলুর রহমান দাবি করেছেন, তাঁর গ্রুপ এত ঋণ করেনি। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আমার কাছে পায় ১৫০ কোটি টাকা। আর সুদ হিসাবে নিয়ে তারা এই তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু সুদ তো আগেই মওকুফ করে নিয়েছি। ফলে সেগুলোর হিসাব এখানে আসতে পারে না।’
জনতা ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম ছাড়াও অগ্রণী ব্যাংকের ঋণে বড় অনিয়মের তথ্য রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে। একইভাবে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট ও ঢাকার স্থানীয় কার্যালয়ের ঋণেও অনিয়ম রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার লিমের বিপরীতে মালামাল ব্যাংকের শাখার নিয়ন্ত্রণে নেই এবং বড় অঙ্কের ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আমিনুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গতকাল তিনি এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

No comments

Powered by Blogger.