সেমিনারে বিচারপতি হাবিবুর রহমান-মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া ও প্রত্যাহারে দুর্নীতি বাড়ছে

মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া এবং প্রত্যাহারের কারণে দুর্নীতি বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি মামলা চূড়ান্তভাবে শেষ হয়েছে।
গতকাল রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যালয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হাবিবুর রহমান এ কথা বলেন।
‘দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এ সেমিনারে আলোচকেরা দুর্নীতির বিস্তারে রাজনীতিকদের ভূমিকা, দুর্নীতি মামলায় আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার ও রাজনীতিবিদদের করণীয় এবং মিডিয়ার ভূমিকার মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিককে দলে টানার জন্য তাঁর জামিন দেওয়া-নেওয়া নিয়ে যে প্রহসনের সৃষ্টি হয়, তাতে আদালতের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের মামলার শুনানি বিলম্বিত হয় সরকারের আইন পরামর্শকদের অনাপত্তিতেই।
সাবেক এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘দুর্নীতির প্রসার ঠেকাতে প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হবে, অর্থাৎ সরকারকে যথাযথ আইন প্রণয়ন করে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে হবে।’
এর আগে সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন। প্রবন্ধে দুর্নীতি ও এর প্রকারভেদ, জাতীয় নিরাপত্তা, ব্যক্তি খাতের দুর্নীতি, বাংলাদেশের দুর্নীতিতে বিদেশি প্রভাব, দুর্নীতি প্রতিরোধে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের অবস্থানকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করেন। তিনি দুদকের চেয়ারম্যানের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন, শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির জন্য মাত্র একজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। কিন্তু যাঁরা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের নাম আসেনি। যাঁরা কৃত্রিম বৃদ্ধি দেখিয়ে জনগণকে ঠকিয়েছেন, যাঁদের কারণে দুই শেয়ার ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। ব্যবসায়ীরা আপনার সঙ্গে থাকবেন।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কিছু বিষয়ে দুদকের কিছু করতে না পারার জন্য ‘আইনি’ ও ‘বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতার’ যুক্তি দেন। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারসহ অনেক অপরাধই দুদক তদন্ত করতে পারেনি। কারণ, শেয়ারবাজারে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির লেনদেন নিয়ে যেসব কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তা দুদক আইনের আওতার বাইরে। দুদকের চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত-সাক্ষ্য দিয়ে সহায়তা করেন না।
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটাই। কিন্তু তা রোধ করতে গাঁইগুঁই করি। সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি খুব কাছের কোনো আত্মীয় হয়ে যান।’
মূল প্রবন্ধে উপস্থাপিত ‘রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দুর্নীতির চালিকাশক্তি’ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি দমনে যা-ই বলুক না কেন, বর্তমানে তাদের যে অবস্থা, তার কুফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দুর্নীতির চালিকাশক্তি—কথাটির সঙ্গে আমি একমত।’
আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফজলে রাব্বি মিয়া বলেন, দেশের মানুষ যখনই গণতন্ত্রের দিকে যেতে চেয়েছে, তখনই কোনো দিক থেকে বাধা এসেছে। এ জন্য দুর্নীতি দমন হচ্ছে না। রাজনীতিবিদেরা চাইলেই দুর্নীতি কমাতে পারেন।
দ্বিমত প্রকাশ করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল মঈন খান বলেন, দুর্নীতির জন্য রাজনীতিবিদেরাই প্রধানত দায়ী—এ কথা ঠিক নয়। বিশ্বের সব দেশে দুর্নীতির মূল সূতিকাগার সরকারি খাত। মূল প্রবন্ধে এটি উল্ল্লেখ করা হয়নি। রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা এক হয়েই দুর্নীতি করেন। দুর্নীতি রোধে মূল পদ্ধতিরই আধুনিকায়ন প্রয়োজন। ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকাতে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ থাকতে হবে।
“রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া দুর্নীতি সম্ভব নয়—বিষয়টি স্বীকার করেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি হওয়ার আগে নয়, পরে কমিশন এগুলো নাড়াচড়া করে। আগে থেকেই এটি প্রতিরোধ করা দরকার। সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সামরিক শাসন এসে প্রথমে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে দিন দিন দুর্নীতি বাড়ছে।
সরাসরি সরকার নয়, বরং যারা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত আছেন, তাঁরাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে মত দেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দুর্নীতি বিষয়ে রাজনীতিকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা ঠিক হবে না।
মিডিয়া বিভক্ত বলে একজনের তিল পরিমাণ দুর্নীতিকে অন্যজন তাল পরিমাণে উপস্থাপন করছে—প্রবন্ধে উপস্থাপিত এ বক্তব্য খণ্ডন করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম বলেন, ‘পেশাগতভাবে সাংবাদিকেরা বিভক্ত নন। শুধু দুটি ইউনিয়ন রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। সংবাদপত্রের ভূমিকাতেই অনেক দুর্নীতি বেরিয়ে এসেছে।’ সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার একই অভিমত দেন। তিনি বলেন, ‘মিডিয়ায় বিভক্তি নেই। নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ না হলে দুর্নীতি দমানো সম্ভব নয়। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে।’
নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দুর্নীতি দমন বিষয়ে মিডিয়ায় কোনো দ্বিমত বা বিভক্তি নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব সময় মিডিয়া কঠোর অবস্থানে আছে। বরং দুদকই ক্ষমতাসীনদের কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় না।
প্রবন্ধের ওপর আরও আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক রাষ্ট্রদূত ইনাম আহমেদ চৌধুরী ও হুমায়ূন কবির, সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদল, বিজিএমইএর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.