কথা-মৃত by মাইনুল এইচ সিরাজী

এশিয়া কাপের চরম উত্তেজনার সময় আপনার শরীর-মন ঠিক রাখার জন্য বিরোধীদলীয় সাংসদ রেহানা আক্তার ব্যাপক বিনোদনের জন্ম দিয়েছেন। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে আপনি যদি এই ‘ডার্টি পিকচার’ দেখে ফেলেন, তাহলে নির্ঘাত সেই দৃশ্যগুলো আপনার চোখের সামনে ভাসছে, কানে বাজছে রেহানার কথামৃত।


তাঁর কথাগুলো সত্যিই অ-মৃত। কারও ভালো ভাষা যখন মৃত্যুবরণ করে, তার মুখ থেকে তো অ-মৃত বাণীই বেরোবে। এতে অবাক হওয়ার কী আছে? সুতরাং বিনোদিত হোন।
কথায় বলে, ব্যবহারে বংশের পরিচয়। এখন মনে হচ্ছে, ব্যবহারে দলের পরিচয়। আরও সহজভাবে বললে, ব্যবহারে রেহানার পরিচয়। সেই অবিস্মরণীয় ব্যবহার দিয়ে তিনি নিজেকে জনতার কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এর আগে কেউ তাঁর নামও জানত না।
ভাষার জন্ম হয়েছে পাঁচ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। এর মানে হচ্ছে, হাজার হাজার বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পৃথিবীতে এসেছে, সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে কোনো কথা না বলে! ভাবা যায়? এ জন্য হয়তো পরের প্রজন্ম বেশি বেশি কথা বলে পূর্বপুরুষদের কথা বলার ঘাটতি পুষিয়ে দিতে চেয়েছে। আর এ কাজে যে রাজনীতিবিদেরা এগিয়ে আছেন তা বলাই বাহুল্য।
বাংলা ভাষার জন্ম সপ্তম শতকে। আচ্ছা বলুন তো, বাংলা ভাষার জন্মের আগে এ অঞ্চলের মানুষ কীভাবে কথা বলত? কেন, ইশারা-ইঙ্গিতে! না, হলো না। বাংলার ঠিক আগের ধাপ বঙ্গ-কামরূপী ভাষায় কথা বলত। হা হা হা।
মানুষ দাবি করে, একমাত্র তারাই কথা বলতে পারে। তোতা-ময়না যা বলে তা শেখানো বুলি। এটা মেনে নিলে বলতেই হয়, কথা দিয়েই বোঝা যায় কে মানুষ আর কে মানুষ নয়। সুতরাং যাঁদের কথা শুনে আপনার কান-প্রাণ ঝালাপালা হচ্ছে, আপনি একটু যাচাই করে দেখুন তাঁরা মানুষ কি না। তবে যাচাই করে আবার তাঁদের মুখের ওপর অমানুষ বলে বসবেন না। পিঠ বাঁচানো দায় হবে তাহলে। ওই কথাবাজদের ক্ষমতা অনেক। তাই যা বলার বলুন সাবধানে এবং কম কথা বলুন। এতে লাভ আছে। কম খেলে যেমন ওজন কমে, তেমনি কম বললে ওজন বাড়ে।
রাজনীতির কথা থাক। ঝুঁকি নিতে চাই না। চলুন অন্যদিকে যাই। কোথায় যাব, সংসদ ছেড়ে বাসায়? উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায়? তবে তাই হোক। এক রোমান্টিক ভদ্রলোক বিয়ের পর সারা রাত স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করে কাটাতেন। সহসা গল্প কমতে কমতে ভদ্রলোক একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে তিনি আইন পেশা শুরু করেছেন। এখন রাতে বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কোনো কথাই আর বলেন না। স্ত্রীর জোরালো জেরায় আইনজীবী স্বীকার করলেন—‘টাকা ছাড়া আমার কথা বেরোয় না’। তাঁর এই অজুহাতটা ভালো। সংসার-যন্ত্রণা এড়ানো তো গেল। কোনো এক রসিক পুরুষ কথার মারপ্যাঁচে তাঁর বন্ধুকে বোঝাচ্ছেন, ‘সারা দিন আমার বউ বলে, আমি শুনি। আর সারা রাত আমি শুনি, আমার বউ বলে।’ সংসারের উত্তাপ কমানোর এই একমাত্র উপায়—চুপ থাকা। বোবার কোনো শত্রু নেই। সংসারে ভালো থাকতে চাইলে চোখ-কান খোলা রাখুন, কিন্তু মুখ খুলতে যাবেন না। মা তাঁর মেয়েকে বলছেন, আমার কথা শুনলে প্রতিদিন একটা করে আইসক্রিম পাবে। মেয়ে বলল, আচ্ছা। তবে বাবাকেও দিতে হবে। বাবা তো তোমার কথা শোনে। এই মেয়ে বড় হয়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে বিয়ের আগে বাবার কথা শোনার জন্য তার মায়ের সেকি আকুতি ছিল—অনাবশ্যক য-ফলাময় আকুতি—অ্যাই, চুপ করে আছো কেন? তুমি এত সুন্দর করে কথা বলো, আমি পাগল হয়ে যাই, আনন্দে ভেসে যাই ইত্যাদি। হে প্রেমিক পুরুষ, বিনা পয়সায় একটা উপদেশ দিচ্ছি, যত্ন করে রাখবেন। এক জীবনে যা বলার এখনই বলে নিন। নইলে পরে পস্তাবেন।
আগেই বলেছি, কথায় মানুষ চেনা যায়। যে নেতা জনগণের ‘সেবা’ করার সুযোগ চেয়ে কথার মালা গাঁথেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করুন, সেবা করার জন্য তাঁর এত লোভ কেন? স্কুল-কলেজের গেটে যে নায়করাজেরা কথার বাণ ছুড়ে মেয়েদের হূদয় জয় করতে চায়, তাদের পরিবারে শ্লীলতা আর রুচির চর্চা হয় কি না সন্দেহ করুন। এতটা কষ্ট যদি না করতে পারেন, তবে ‘কথার কথা’ বলে বাংলায় যে বাগ্ধারাটি আছে তার আশ্রয় নিন। অর্থাৎ সব অসংগত কথাবার্তাকে বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিন। বাজে কথা নিশ্চয়ই ভালো লোকেরা বলে না। আরেকটা কথা। খাওয়াদাওয়া, পোশাক-আশাক ইত্যাদির মতো কথাবার্তায়ও স্মার্ট আর আধুনিক হওয়া দরকার। এটা তো সবাই জানি—নিয়ম মেনে স্মার্ট হতে হয়, নিয়ম ভেঙে নয়।

No comments

Powered by Blogger.