কেমন আছেন উত্তরাবাসী-৫-রাস্তার চাঁদাবাজি এখন গোপনে by আপেল মাহমুদ

উত্তরা মডেল টাউনের রাস্তায় বের হলে মনে হবে সব কিছুই ঠিকঠাক আছে। কোথাও কোনো ঝামেলা নেই। শান্তিতেই আছে সবাই। কিন্তু একটু গভীরে দৃষ্টি দিলে প্রকাশ পায় নানা অবৈধ কারবার। উত্তরায় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় ও পুলিশের নামে মাঠের চাঁদাবাজি চলে গেছে গোপন ডেরায়।


লাইনম্যানদের দিয়ে চাঁদা তুলে নেতা ও পুলিশ ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তরায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ঘন ঘন যাতায়াত আর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার নিসারুল আরিফ ও উপকমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদুর রহমান ভূঁইয়ার পদক্ষেপের কারণে চাঁদাবাজরা প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা চালাতে পারছে না। কিছু দিন আগেও উত্তরার সব ফুটপাত অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেখান থেকে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের লাইনম্যানরা লাখ লাখ টাকার চাঁদা ওঠাত। বর্তমানে ফুটপাতে একটি দোকানও দেখা যায় না। অতীতে ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার গাড়ি থামিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করলেও ইদানীং সে দৃশ্য চোখে পড়ে না বললেই চলে। তবে কৌশল পরিবর্তন করে এখন গোপনে চলছে অবৈধ লেনদেন।
এ কথা স্বীকার করে উত্তরা, দক্ষিণখান ও উত্তরখান থানা এলাকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব হাবিব হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, এখানকার কোনো কোনো নেতা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ব্যাটারিচালিত টেম্পো এবং অবৈধ দোকানপাট থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছে। তবে তারা প্রকৃত আওয়ামী লীগার নয়। তারা এক সময় বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি কিংবা ফ্রিডম পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বিশেষ একটি জেলার নাম করে লাইনম্যান নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করছেন। তাদের কারণে পুলিশকে পর্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তবে সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য এসব নব্য আওয়ামী লীগারদের মুখোশ উন্মোচন করে দল থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানান প্রবীণ এ নেতা।
আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তরা হয়ে শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের কোনোটাই চাঁদাবাজির বাইরে নয় বলে সরেজমিন তদন্তে জানা যায়। গাজীপুর থেকে ঢাকা চলাচলকারী বলাকা, বনশ্রী প্রভাতী, স্কাইলাইন, আজমেরি এবং আবদুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান, মতিঝিল, আজিমপুর ও মিরপুর এলাকায় যাতায়াতকারী ১০/১২টি কাউন্টার সার্ভিস এবং ৩ নম্বর ও ২৭ নম্বর বাস ও চলাচল পরিবহন থেকে প্রত্যেক পুলিশ সার্জেন্টের নামে সপ্তাহে ৩০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। উত্তরা বিভাগে কর্মরত ৩০ জন সার্জেন্টই এ হারে চাঁদা পেয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে আবদুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান যাতায়াতকারী ৩ নম্বর বাসের এক মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উত্তরা এলাকার ওপর দিয়ে যেসব গাড়ি চলে, তার সব থেকে পুলিশকে 'সপ্তাহ' কিংবা 'মাসোহারা' দিতে হয়। তবে ট্রাফিক পুলিশের টিআই মিজানুর রশিদ কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, তিনি কোনো গাড়ি থেকে চাঁদা নেন না।
গাজীপুর থেকে আজিমপুর যাতায়াতকারী ২৭ নম্বর গাড়ির চালক খুরশেদ বলেন, উত্তরা বিভাগের ট্রাফিক পুলিশের প্রত্যেক সার্জেন্টকে সপ্তাহে ৩০০ এবং টিআইকে মাসে ৩০০০ টাকা করে প্রতিটি বাস কম্পানির লোক চাঁদা পৌঁছে দেয়, যাতে রাস্তায় তাদের গাড়ির বিরুদ্ধে কোনো মামলা না করা হয়।
এ টাকা শুধু সার্জেন্ট এবং টিআই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময় এসি বা এডিসির নামেও চাঁদা তোলা হয় বলে পুলিশের একটি সূত্র জানায়। তবে বর্তমান ট্রাফিকের ডিসি এসব অবৈধ লেনদেন প্রশ্রয় দেন না বলে একাধিক বাস কম্পানির লোকজন কালের কণ্ঠকে জানান।
অভিযোগ রয়েছে, উত্তরা এলাকায় চলাচলকারী প্রায় ১০০০টি ব্যাটারিচালিত টেম্পো, শতাধিক হিউম্যান হলার থেকে দৈনিক মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হচ্ছে ট্রাফিক ও থানা পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতাদের নামে। প্রতিটি ব্যাটারিচালিত গাড়ি থেকে ১২০ টাকা হারে প্রতিদিন এক লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। আবদুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ, হাউস বিল্ডিং, আজমপুর, জসীম উদ্দিন এভিনিউ, কসাইবাড়ী পয়েন্টে এসব টাকা তোলা হয়। আবদুল্লাহপুরে এ চাঁদা তুলছে নুরু, মাসুদ, মোস্তফা, তারেক প্রমুখ। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুজন নেতার নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তুলছে। বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিক দিন যোগাযোগ করেও তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। হোসেন আলী নামে একজন চালক জানান, আবদুল্লাহপুর থেকে সাভার ও নবীনগরগামী হিউম্যান হলার কম্পানি থেকে প্রতিদিন তিন হাজার করে মাসে এক লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় ট্রাফিক পুলিশের নামে। আবার এ টাকার দ্বিগুণ চাঁদা দিতে হয় উত্তরা থানা পুলিশকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উত্তরা এলাকায় নিয়মিত যাতায়াতকারী বালির ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেনিং গাড়ি, মুরগি পরিবহনের বিশেষ গাড়ি, মালবাহী পিক-আপ ও প্রাইভেট সিএনজি বেবিট্যাক্সি থেকে পুলিশের নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে মাসোয়ারা ভিত্তিতে। অভিযোগ আছে, ট্রাফিক পুলিশের এ এস আই সাইফুল ৩০টি ট্রেনিং কার থেকে মাসে ৩০ হাজার, ৩০টি কাভার্ড ভ্যান থেকে মাসে ৯০ হাজার, ২৫টি ইট-বালু বহনকারী ট্রাক থেকে ২৫ হাজার এবং মুরগি বহনকারী ১০টি বিশেষ ভ্যান থেকে ১৫ হাজার করে মাসোহারা আদায় করে থাকেন। তবে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে এ এস আই সাইফুল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাকে রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন গাড়ির বিরুদ্ধে মামলাও করতে হয়, যে কারণে কেউ কেউ অভিযোগ করতেই পারে।
উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের ভেতরে ঢুকে প্রায় ৫০টি স্টাফ বাস নিয়মিত কর্মচারী-কর্মকর্তা আনা-নেওয়া করে থাকে। কিন্তু মামলার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিটি বাসকে ১০০০ টাকা করে মাসোহারা তুলে দিতে হয় ট্রাফিক পুলিশের হাতে- এমন অভিযোগ করলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ বাসের চালক। তা ছাড়া উত্তরা এলাকায় গাজীপুর ও সাভারের রুট পারমিটধারী প্রায় ১০০টি প্রাইভেট সিএনজি বেবিট্যাক্সি চলাচল করে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী এ সব বেবিট্যাক্সি ঢাকা মেট্রো এলাকায় চলাচল করা বেআইনি। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের কোনো কোনো সার্জেন্ট গাড়িপিছু ১০০০ টাকা মাসোহারা চুক্তিতে সেসব গাড়ির সব দায়িত্ব নিচ্ছেন। অন্য কোনো ট্রাফিক পুলিশ এসব গাড়ি আটক করলে তারা ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। গাজীপুরের রুট পারমিটধারী একাধিক বেবিট্যাক্সি চালক এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পুলিশকে ম্যানেজ করতে না পারলে এক দিনও উত্তরা এলাকায় গাড়ি চালানো যাবে না।
সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না বলে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না, বললেন উত্তরা বিভাগ পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদুর রহমান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, কেউ যদি চাঁদাবাজির প্রতিকার চেয়ে আবেদন করে তাহলে নিশ্চয়ই অভিযুক্ত ট্রাফিক সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু অধিকাংশ লেনদেন যোগসাজশের মাধ্যমে হওয়ার কারণে অভিযোগগুলো ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। ট্রাফিক পুলিশের দ্বারা চাঁদাবাজির শিকার হলে ভুক্তভোগীদের সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.