সেচের জন্য বিদ্যুৎ যাচ্ছে সামান্যই by অরুণ কর্মকার

সারা দেশে এক ঘণ্টা পর পর লোডশেডিং করা হচ্ছে যে সেচের অজুহাত দেখিয়ে, সেই সেচের জন্য বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে সামান্যই। প্রায় ৮০ শতাংশ সেচভুক্ত এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সূত্র জানায়, সেচে বিদ্যুৎ সরবরাহ-পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায়ও এ বছর খারাপ।


আরইবির ১১টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) মহাব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, সেচের জন্য বিদ্যুতের যে চাহিদা, তার তুলনায় পাওয়া যাচ্ছে গড়ে অর্ধেকের কিছু বেশি। তা ছাড়া, লো-ভোল্টেজের কারণে পানির পাম্প চালানো না যাওয়া আরেকটি বড় সমস্যা। অথচ গত বছর লোডশেডিং সত্ত্বেও রাতের বেলা সেচের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে।
আরইবির ‘সিস্টেম অপারেশন’ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সেচসহ পল্লী বিদ্যুতের ৮০ লক্ষাধিক গ্রাহক গত ২৯ মার্চ দিনের বেলার সর্বোচ্চ চাহিদার সময় বিদ্যুৎ পেয়েছে চাহিদার তুলনায় ৩৫ শতাংশ। ওই দিন রাতে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় পেয়েছে ৩৬ শতাংশ।
গত ৩০ মার্চ দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় পেয়েছে চাহিদার ৩৬ শতাংশ এবং রাতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় পেয়েছে ৩৭ শতাংশ। ৩১ মার্চ দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় পেয়েছে ৩৭ শতাংশ এবং রাতে ৪০ শতাংশ।
আরইবি সূত্র জানায়, ৩০ ও ৩১ মার্চ সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় ওই দুই দিন অন্যান্য দিনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে। মার্চের মধ্যভাগ থেকে সেচের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার পর থেকেই এ অবস্থা চলছে।
আরইবির একাধিক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের আওতাভুক্ত এলাকায় লোডশেডিং তো বেশির ভাগ সময়ই থাকে। তবে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা সেচ নিয়ে। সরকারি পরিকল্পনা ও ঘোষণা অনুযায়ী রাত ১১টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত সেচের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য কৃষক দিনের বেলায়ও যখন যেখানে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন, সেখানেই পানির পাম্প চালানোর চেষ্টা করছেন।
নীলফামারীর ডিমলার কৃষক আমিনুর রহমান গতকাল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন আগে আরইবির চেয়ারম্যান তাঁদের অনেকের কাছে মুঠোফোনে পাঠানো খুদে বার্তায় বলেছিলেন রাত ১১টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত সেচপাম্প চালাতে। কিন্তু বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। বিদ্যুতের জন্য রাত ১১টা থেকে বসে থাকলেও বিদ্যুৎ আসে কোনো দিন ১২টায়, কোনো দিন একটায়। ভোর পাঁচটা-ছয়টার দিকেই বিদ্যুৎ চলে যায়।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের দুজন কৃষক বলেন, ভোল্টেজ কম থাকায় অনেক সময়ই পাম্প চলে না। আরইবির কর্মকর্তারা বলেন, যেখান থেকে বিদ্যুৎ আসে সেখানেই ভোল্টেজ কম। এভাবে সেচ চালানো যাবে না।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির একাধিক সূত্র জানায়, ১৩২ হাজার ভোল্টের (কেভি) সঞ্চালন লাইনে ভোল্টেজ থাকে ১২০ থেকে ১২৫ কেভি। এরপর তা ৩৩ হাজার ভোল্টের লাইনে গেলে সেখানে ভোল্টেজ পাওয়া যায় ২২ থেকে ২৬ হাজার। ১১ হাজার ভোল্টের লাইনে সাত থেকে নয় হাজারের বেশি ভোল্ট পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েকটি বিতরণ কোম্পানির সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ার পাশাপাশি ভোল্টেজ সমস্যারও সমাধান হতো। কিন্তু তেলচালিত বেশির ভাগ কেন্দ্রই বন্ধ রাখা হয়।
সরেজমিনে সেচ-পরিস্থিতি দেখার জন্য দুই দিন ধরে বিদ্যুৎসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) ও আরইবির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা উত্তরাঞ্চল সফর করেছেন। গত শনিবার রাজশাহী ও রংপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেচে বিদ্যুতের সমস্যা নিয়ে সভা হয়েছে।
শনিবার বগুড়া সার্কিট হাউসে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিদ্যুৎসচিব বলেন, তিন বছরে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়লেও এই সময়ে গ্রাহক বেড়েছে এক কোটি ২৫ লাখ। উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুৎ-সংযোগ বেড়ে যাওয়ার কারণে এই সেচ মৌসুমে লোডশেডিং করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ১৫ এপ্রিলের মধ্যে এই লোডশেডিং কমার কোনো লক্ষণ নেই। জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য দেন সাংসদ আকরাম হোসেন চৌধুরী, পিডিবির চেয়ারম্যান এস এম আলমগীর প্রমুখ।
সচিব বলেন, লো-ভোল্টেজের কারণে মেশিন পুড়ে গেছে—এমন খবর তাঁর কাছে রয়েছে। তবে বিদ্যুতের জন্য মাটি ফেটে চৌচির অবস্থা হয়নি।
সভা সূত্রে জানা গেছে, আরইবি এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সভাগুলোতে রাত-দিননির্বিশেষে বিদ্যুতের অস্বাভাবিক লোডশেডিং, সেচের জন্য নির্ধারিত সময়ে (রাত ১১টা থেকে সকাল সাতটা) চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ পাওয়া এবং লো-ভোল্টেজের কারণে সেচপাম্প চালাতে না পারার কথা জানানো হয়।
সভাগুলোতে পিডিবির পক্ষ থেকে অস্বাভাবিক লোডশেডিং সম্পর্কে শুধু উৎপাদন ঘাটতির সেই চিরাচরিত কথা বলা হয়েছে। আর লো-ভোল্টেজের দায় চাপানো হয়েছে কৃষকের ওপর। বলা হয়েছে, সঠিক ভোল্টেজে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য প্রতিটি সেচপাম্পের সঙ্গে ‘ক্যাপাসিটর ব্যাংক’ (ভোল্টেজ বাড়ানোর যন্ত্র) স্থাপনের কথা। তা করা হয়নি বলে লো-ভোল্টেজের সমস্যা হচ্ছে।
তবে বিদ্যুৎ খাতের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সব সমস্যার মূল হচ্ছে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন। দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু জ্বালানি-সংকট ও সরকারের আর্থিক সাশ্রয়ের নীতির কারণে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না।
শুধু সন্ধ্যাকালীন সর্বোচ্চ চাহিদার সময় (সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত ১১টা) ছাড়া তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো হয় না। অথচ এসব কেন্দ্রে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি—এই অজুহাতে বর্তমান সরকারের আমলেই পাঁচবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। মানুষ বেশি দাম দিচ্ছে কিন্তু বিদ্যুৎ পাচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.