নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-কী হবে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

পত্রপত্রিকায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সংবাদ পড়ে মন ভালো হয়ে যায়। এর মধ্যে সেনা অভিযানে সহায়ক রোবট, বিদ্যুৎ অপচয় কমানোর টাইম সুইচ, ক্যালকুলেটরের সৌরকোষ ব্যবহার করে সূর্যের শক্তি পরিমাপের মতো নানা রকম উদ্ভাবনের সংবাদ পড়েছি


আমরা। গত ডিসেম্বরে চুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগ আয়োজন করেছিল নবায়নযোগ্য শক্তিবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যেখানে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের গবেষকেরা। ১৫৯টি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল এই সম্মেলনে। এ ছাড়া বিতর্ক প্রতিযোগিতা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নিয়মিত আয়োজন বলে দেয় কতটা প্রাণবন্ত চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের প্রকৃতিশোভিত এই ক্যাম্পাসটি।
এ পর্যন্ত লিখে যে দুঃসংবাদটি পাঠককে দিতে হবে তা হলো, ২৪ দিন ধরে অচল হয়ে আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানসহ সব কার্যক্রম। ছাত্ররা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছে ক্লাসরুম। জানি না সরকারি ঔদাসীন্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নিজেদেরই শিক্ষাজীবনের ক্ষতি করে কার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে এই শিক্ষার্থীরা।
প্রায় দুই মাস ধরে চুয়েটে কোনো উপাচার্য নেই। দুই দফায় চার বছর উপাচার্য ছিলেন শ্যামল কান্তি বিশ্বাস। তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রায় দুই মাস কোনো উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য নেই, উপ-উপাচার্যও নেই। তাহলে কার নির্দেশে বা তদারকে চলছে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড?
চুয়েটের শিক্ষক সমিতি উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে, সরকারকে তিন দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে, তাতেও কোনো সাড়া না পেয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে মানববন্ধন, মৌন মিছিল ও অবস্থান ধর্মঘট করেছে। উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে চুয়েটের কর্মচারীরাও। কিন্তু কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙেনি।
দুর্ভাগ্য, আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলি, কিন্তু ধ্বংসাত্মক পথে না গেলে কোনো সমস্যা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না। এই অভিজ্ঞতা থেকে কিনা জানি না, চুয়েটের ছাত্ররা নিজেদের ক্লাস বর্জন করে দাবি আদায়ে নেমেছে। আরও এক ধাপ এগিয়ে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক অবরোধ করেছে।
শুনেছি উপাচার্য নিয়োগের আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা শামিল হওয়ার পেছনে কোনো কোনো শিক্ষকের ইন্ধন আছে। দু-একজন শিক্ষকের উপাচার্য হওয়ার ‘সুপ্ত বাসনা’ পূরণের হাতিয়ার হিসেবে এই ছাত্ররা ব্যবহূত হচ্ছে এমন কথাও চালু আছে ক্যাম্পাসে। এসব কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কেননা উপাচার্য না থাকা যতটা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে, ততটা ক্লাসের শিক্ষা কার্যক্রমকে তো করে না। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা আগ বাড়িয়ে কেন নিজেদের ক্ষতি করে এ আন্দোলনে জড়াতে গেল?
আমরা চাই, চুয়েটে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করুক সরকার। ক্লাসে ফিরে যাক ছাত্রছাত্রীরা। আন্দোলনের নামে যে কটি দিন অপচয় হলো তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে।

২.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও করুণ। একটি তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে দুজন ছাত্র নিহত হওয়ার পর দীর্ঘ ৩৮ দিন বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। এর মধ্যে মামলা ও পাল্টা মামলা, তদন্ত কমিটি, লিয়াজোঁ কমিটি গঠন ইত্যাদি নানা প্রক্রিয়া পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলে গত ১৮ মার্চ। খোলার আগে লিয়াজোঁ কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করেছে বিভিন্ন ছাত্র ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। ছাত্রশিবিরের নেতাদের সঙ্গেও দুই দফায় বৈঠক করেছে তারা।
এত কিছু সত্ত্বেও নির্বিঘ্ন হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর উদ্যোগ। খোলার দিন থেকেই ধর্মঘট ডেকে, ক্যাম্পাসে ঝটিকা মিছিল করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে রেখেছে ছাত্রশিবির। ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি বন্ধ করতে না পেরে কোনো কোনো স্থানে শাটল ট্রেনের লাইন তুলে ফেলে, ক্লাসরুম ও শিক্ষকদের কক্ষের দরজার তালায় সুপার গ্লু ঢেলে দিয়ে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে শিক্ষা-কার্যক্রম।
এখন কিছু বিভাগে ক্লাস হচ্ছে বটে, ছাত্রছাত্রীদের ভীতি-আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি। হেন কোনো পন্থা নেই, যা অবলম্বন করেনি শিবির। এসব কারণে ক্লাস চললেও পরীক্ষার কর্মসূচি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত কর্তৃপক্ষ। ছাত্রশিবির কয়েক দিন ধরে ক্যাম্পাসে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তাতেই তাদের আসল চরিত্র প্রকাশিত। ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর জাতীয় ছাত্রসমাজের সভাপতি আবদুল হমিদের হাতের কবজি কেটে শূন্যে ছুড়ে পৈশাচিক উল্লাসের মধ্য দিয়ে যে নৃশংস রাজনীতির সূচনা করেছিল শিবির, সে পথ থেকে তারা কখনো বেরিয়ে আসেনি। ১৯৯০ সালে ছাত্রদলসহ সব কটি ছাত্রসংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছিল ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে। নির্বাচনে পরাজিত হলেও শিবিরের তৎপরতা থামেনি। বারবার তারা সংঘর্ষে জড়িয়েছে প্রগতিশীল ছাত্রসংঠনগুলোর সঙ্গে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, ধ্বংস হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীর মূল্যবান শিক্ষাজীবন।
গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে শিবির। এ সময় ছাত্রদলের কোনো তৎপরতা দেখা না গেলেও প্রশাসনের আনুকূল্য লাভ করেছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্তত ৪০০ পদে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকেরা নিয়োগ পেয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষে যে দুজন ছাত্র নিহত হয়েছে তারা দুজনই ছাত্রশিবিরের কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কোনো ছাত্রের লাশ হয়ে ফিরে যাওয়া নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। পিতা-মাতার কাছে এই ক্ষতির, এই শোক ও বেদনার কোনো সান্ত্বনা নেই। কিন্তু লাশ নিয়ে যারা রাজনীতিতে মত্ত, তাদের এ কথা বোঝাবে কে? ঘটনার পরদিন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, সংঘর্ষের অব্যবহিত আগে হাতে লাঠি ও দা নিয়ে অগ্রভাগে ছিল নিহত ছাত্রদ্বয়। এভাবে যারা মৃত্যুর পথ ধরে হাঁটে তাদের ফেরাবে কে?
অন্যদিকে, ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে দু কথা না বলে এ লেখা শেষ করা যাবে না। ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকার সবচেয়ে বেশি বিব্রত হয়েছে ছাত্রলীগের কারণে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের কর্মীরা নানাভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অশান্তি ও দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। নানা সময় নিজেদের মধ্যেও কোন্দল-সংঘর্ষে জড়িয়েছে তারা। সম্প্রতি নিজেদের সভাপতিকে ‘শিবিরের চর’ বলে লাঞ্ছিত করেছে চবি ছাত্রলীগেরই একাংশ। এতে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। পত্রিকায় দেখেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় দুজন মেধাবী আবেদনকারীকে বাদ দিয়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের চেয়ে খারাপ ফল করা দুজনকে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পর তাকে সচল রাখার দায়িত্ব এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। শিবিরের তৎপরতার কারণে যদি সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যেতে না পারে, নিয়মিত পরীক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারে তাহলে প্রশাসনের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.