সিটি সার্ভিসের বাসে চাঁদাবাজিঃ দিনবদলের ভেতরের কথা

আওয়ামী মহাজোট সরকারের আমলেও সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে চাঁদাবাজি। অজপাড়া গাঁ থেকে রাজধানী, কোথায়ও এর ব্যতিক্রম নেই। সরকারদলীয়দের দাপট থেকে রেহাই পেতে চাঁদাবাজির উত্পাত মেনে নেয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষ করে যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত তারা চাঁদা দেয়াকে নিজেদের বাজেটভুক্ত করে নিতে বাধ্য হয়েছেন বলা যায়। ক্ষমতাসীনরা মুখে যতই বিরোধিতা করুন না কেন, চাঁদাবাজির সঙ্গে তাদের সংস্রব দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। তাই এ অবস্থাকে মেনে নেয়ার জন্য কাউকে দোষ দেয়া কঠিন বৈকি। রাজধানীর পরিবহন ব্যবসায়ীদের অবস্থাও তদ্রূপ। প্রতিদিনই তাদের হাজার হাজার টাকা চাঁদা গুনতে হয়, যার চাপ এসে পড়ে যাত্রী-সাধারণের ওপর। এ শহরে চলাচলকারী যাত্রী পরিবহনে চাঁদাবাজিতে জড়িত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) সরকার-সমর্থকদের সংগঠিত চক্র। গতকালের আমার দেশ-এ বিষয়টি নিয়ে তথ্যবহুল রিপোর্ট ছাপা হয়েছে।
রাজধানীতে প্রতিদিন চলাচলকারী পাবলিক বাসের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির বাস তিন হাজারের কম নয়। ডিসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের রাজধানীতে চলাচলকারী বাসগুলো থেকে নিয়মিত টোল আদায় করার কথা। বিগত দিনে নগরীর পাঁচটি বাসটার্মিনাল থেকে নির্ধারিত ইজারাদারদের মাধ্যমে টোল আদায় করা হতো। তখন টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারাদার নিয়োগ দেয়া হলেও বর্তমানে বিনা টেন্ডারে সরকারি দলের লোকজনই টোল আদায় করছে। তবে কোম্পানির বেশিরভাগ বাস টার্মিনাল ব্যবহার করে না। তারা রাস্তার পাশে কাউন্টার খুলে ব্যবসা করছে। তাদের কাছ থেকেও টোলের নামে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ডিসিসির সরকার-সমর্থক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিদিন এ টাকা আদায় করলেও তা ডিসিসির ফান্ডে জমা পড়ে না। প্রতি মাসে এভাবে আদায় হচ্ছে কমপক্ষে ১২ লাখ টাকা। বছরে এ লুটপাটের পরিমাণ দেড় কোটি টাকার কম নয়। এভাবে চাঁদা দেয় বলেই পাবলিক বাসগুলো রাজপথে ইচ্ছাস্বাধীন চলাচল করার সাহস পায়। নিয়ম-শৃঙ্খলা উপেক্ষা করে যেখানে-সেখানে যাত্রী তোলা ও নামানো তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কেউ তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে এগিয়ে আসে না।
টার্মিনালগুলোর ভেতরেও এখন সমানে লুটপাট চলছে। বিনা টেন্ডারে ইজারা নিয়ে টার্মিনালগুলো থেকে চলাচলকারী বাস থেকে সরকার-সমর্থকদের আয়-ব্যয়ের হিসাব নেয়ারও কেউ নেই। বিএনপি জোট সরকারের আমলে বাস টার্মিনালগুলোয় টোল আদায় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বেসরকারি কোম্পানির হাতে বিধিবদ্ধভাবেই তুলে দেয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের চাপে নেয়া সে ব্যবস্থাও শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক থাকেনি। ইজারা নিয়ে কোম্পানিগুলো টোল আদায় করলেও ঠিকমত টাকা জমা পড়েনি ডিসিসির রাজস্ব বিভাগে। তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ডিসিসি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রাজস্ব আদায় শুরু করে। এতে আদায়ের পরিমাণ বাড়লেও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়ে যায়। এভাবে প্রতি মাসে রাজধানীর পাবলিক বাসগুলো থেকে ঠিক কত টাকার টোল আদায় হচ্ছে, তার হিসাব নেই কারও কাছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ডিসিসি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কিছু করার গরজ দেখায় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কেন বিষয়টিতে নাক গলায় না, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার কারণেই ডিসিসির কোটি কোটি টাকার রাজস্ব লুটপাট বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না—এটা কে অস্বীকার করবে?
সুশাসন, জবাবদিহিতা, দুর্নীতির বিরোধিতা, সবকিছুই এক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে আছে। ডিসিসির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা টিকে থাকার ঘটনাই মহাজোট সরকারের স্বরূপ কিছুটা হলেও প্রকাশ করে দেয়। ডিসিসি বঞ্চিত হলেও দলীয় লোকজন লাভবান হওয়াই এ সরকারের কাছে বড় কথা। এটা সম্ভবত দিনবদলের ভেতরের কথা।

No comments

Powered by Blogger.