মিডিয়া ভাবনা-জনসভার সম্প্রচারে বাধা ও র‌্যাবের আপত্তি নিয়ে কথা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

১২ ও ১৪ মার্চ চারদলীয় জোট ও চৌদ্দদলীয় জোটের দুটি জনসভা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনা থেকে দুটি পয়েন্ট নিয়ে আজ লিখতে বসেছি। সংবাদপত্র থেকে জানতে পেরেছি, ১২ মার্চ চারদলীয় জোটের জনসভা তিনটি টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু বিটিআরসি তাদের সেই অনুমতি দেয়নি।

আরও জানা গেছে, চারদলীয় জোটের জনসভা চলার সময় তিনটি টিভি চ্যানেলের প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছিল।
রাজনৈতিক নানা তর্কবিতর্ক, জনসভা বানচাল করার সরকারি নানা উদ্যোগের পাশাপাশি টিভি চ্যানেল নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই ভূমিকা নিন্দনীয়। সরকার একদিকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ করার নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে, অপরদিকে রাজনৈতিক জনসভা সম্প্রচারে বাধার সৃষ্টি করছে। সরকারের এই নীতি পরস্পরবিরোধী।
শুধু বিরোধী দলের জনসভা নয়, সরকারি দলের জনসভাও যদি কোনো টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করে (যেমনটি করেছে ১৪ মার্চ), সেটাকেও আমরা স্বাগত জানাব। কিন্তু সরকার টিভি মিডিয়াকে কেন যেন বড্ড ভয় করছে। টিভি চ্যানেলে দুই জোটের জনসভা প্রচারিত হলে দেশ রসাতলে যেত না। সরকারেরও পতন হতো না। এমনকি এই দুই জোট বা বর্তমান সংঘাতের রাজনীতি নিয়ে যারা আগ্রহী নয়, তারা অনেকে এই জনসভা দেখতই না। অনেক খেলাই তো প্রতিদিন সরাসরি সম্প্রচার হয়। সবাই কি সেই খেলা দেখেন?
কয়েকটি টিভি চ্যানেল চারদলীয় জোটের জনসভা চলার সময় কেন বন্ধ রাখা হয়েছিল, এর জবাব কে দেবে? বিটিআরসি? কেব্ল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন? স্বচ্ছতার স্বার্থে জনগণের কাছে এর ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। আমাদের তথ্যমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, ‘বাংলাদেশে গণমাধ্যম পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে।’ জনাব তথ্যমন্ত্রী, এটা কি তারই নমুনা?
১২ মার্চে চারদলীয় জোটের সমাবেশ ভণ্ডুল করতে ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের সহযোগী নানা সংগঠন যে দমন-নিপীড়ন চালিয়েছিল, তার ব্যাপক প্রচার হয়েছে বিভিন্ন টিভির খবরে ও সংবাদপত্রের পাতায়। দর্শক ও পাঠক দেখেছেন সেসব চিত্র। এ নিয়ে আমাদের নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু টিভি মিডিয়ার ওপর এ রকম নিষেধাজ্ঞা বে-নজির। আশা করি, সরকার তার ভুল বুঝতে পারবে এবং পরবর্তীকালে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না এবং টিভি চ্যানেলের প্রচারও সাময়িক বন্ধ রাখবে না।
এ ঘটনার সূত্র ধরে আমাদের রাজনীতিতে টিভি মিডিয়াকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করার জন্য একটি প্রস্তাব দিতে চাই। টিভি মিডিয়ার শক্তি সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু আমরা রাজনীতির ক্ষেত্রে টিভি মিডিয়াকে সেভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। এ জন্য আমাদের মানসিকতাই দায়ী। আমরা অনেক সময় নতুন কিছু করতে ভয় পাই। সরকারের ভয় হলো, ‘এতে যদি তাদের আরও ক্ষতি হয়ে যায়!’ কিন্তু যে সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে, তারা কেন টিভি মিডিয়ার শক্তিকে রাজনীতির কাজে লাগাতে দ্বিধা করবে?
১২ মার্চের জনসভাকে ঘিরে রাজধানী ঢাকায় যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে টিভি মিডিয়ার কথা আরও জরুরি ভিত্তিতে ভাবা উচিত। আমার প্রস্তাব, আমরা জনসভাকে টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করতে পারি। রাজনৈতিক দল জনসভার লোক আনার পেছনে খরচ না করে সেই টাকা দিয়ে টিভি চ্যানেল থেকে ‘সময়’ ক্রয় করতে পারে। ‘জনসভা’র বক্তব্য যদি টিভিতে প্রচারিত হয়, তাহলে সারা দেশের কোটি কোটি দর্শক ও বিদেশেও লাখ লাখ বাংলাদেশি দর্শক তা দেখার সুযোগ পাবেন। এখন টিভির ‘খবরে’ জনসভার অতিক্ষুদ্রাংশ প্রচারিত হয়। রাজনৈতিক দল যদি এখানেও অর্থ সাশ্রয় করতে চায়, তাহলে শুধু প্রধান নেতার বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচার করতে পারে। এ ধরনের জনসভায় অন্যান্য নেতার বক্তব্য তেমন গুরুত্ব বহন করে না।
পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একটা ছোট জনসমাবেশ আয়োজন করাই যথেষ্ট। ছোট জনসমাবেশ করার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় না। বক্তব্যের মঞ্চে নেতাদের এটা অনুভব করতে হবে, তাঁরা দেশে ও বিদেশের কোটি কোটি মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন। আমাদের মনে হয়, বর্তমান ডিজিটাল যুগে এভাবেই আমাদের এগোনো উচিত।
আজকাল ২৪ ঘণ্টা ‘খবর ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স’ প্রচারের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করেছে। আরও কয়েকটি চ্যানেল চালু হওয়ার পথে। তাদের জন্য এটা একটা লাভজনক অনুষ্ঠান হতে পারে। ‘জনসভা’ নামে তাদের একটা নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানই থাকতে পারে।
আমাদের আশঙ্কা, সরকারের মনে এ নিয়ে একটা ভয় কাজ করছে। তা হলো, ‘জনসভায় বিরোধী দলের নেতারা অসংসদীয় ভাষায় সরকার বা সরকারি নেতাদের সমালোচনা করতে পারে।’ আমাদের মনে হয়, এই আশঙ্কা অমূলক। কারণ জাতীয় সংসদেই তো নেতা-নেত্রীরা যথেষ্ট অশোভন ও অসংসদীয় ভাষা ইতিমধ্যেই ব্যবহার করে ফেলেছেন। এটা আর নতুন কী! এগুলো মানুষের গা-সহা হয়ে গেছে।
সরকার যদি ১২ মার্চের আগে এ রকম একটা নীতি গ্রহণ করত, তাহলে তাদের ১১ ও ১২ মার্চ দেশব্যাপী এত দমনমূলক নীতি গ্রহণ করতে হতো না। জনসাধারণেরও এত দুর্ভোগ হতো না। সরকারও এত সমালোচিত হতো না। চারদলীয় জোটের আগ্রহী সমর্থকেরা ঘরে বসে তাঁদের নেতাদের বক্তব্য শুনতে পারতেন।
আমাদের রাজনীতিতে এখন ‘শোডাউনের’ একটা বাজে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এ ধরনের শোডাউন একমাত্র ভোটের সময় ছাড়া অন্য সময় অপ্রয়োজনীয়। ভোটের ছয় মাস আগে এ ধরনের শোডাউনের হয়তো প্রয়োজন থাকতে পারে। কিন্তু এর আগে নয়। তবু এ ধরনের শোডাউন এবং এর ফলস্বরূপ জনজীবনে দুর্ভোগ আমরা প্রায়ই দেখছি। এর কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। কারণ সরকার নিজেই তো এই দুর্ভোগ তৈরি করে সবচেয়ে বেশি।
এই শোডাউন থেকে আমরা শিগগিরই মুক্ত হতে পারব বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও কর্মীদের হাতে কোনো গঠনমূলক কাজ নেই। হরতাল, জনসভা, মানববন্ধন, সমাবেশ, বিক্ষোভ ইত্যাদি ধরনের অনুৎপাদনশীল কর্মসূচি থাকলেই কেবল তাঁরা চাঙা হতে পারেন এবং তাঁদের হাতে দুটো পয়সা আসতে পারে। যতই অনুৎপাদনশীল হোক, এ ধরনের কর্মসূচি বাদ দিলে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই হুমকির মধ্যে পড়বে।
আমাদের দেশে কোনো দলই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে আগ্রহী নয়। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের বর্তমান দুর্বল কাঠামো এবং অসুস্থ পরিবেশ তারা নানা স্বার্থে বজায় রাখতে চায়। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে কিছু পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে। টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে রাজনৈতিক জনসভার প্রচার তেমনি একটি পদক্ষেপ হতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে ২০১২ সালেই শুরু করা হোক না। এটা তো সংবিধানে যুক্ত করার মতো কোনো নীতি না, যা পরিবর্তন করা কঠিন। এটা একটা সরকারি সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে সরকারকেও কিছু করতে হবে না। সরকারের টাকাও খরচ হবে না। শুধু বলবে, ‘এ ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।’ বাকি কাজ যাদের করার তারাই করবে।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে এটা সরাসরি সম্প্রচার হতে পারে। পথের জনসভাকে যদি আমরা টিভির পর্দায় নিয়ে আসতে পারি, তাহলে এই শোডাউনের রাজনীতি, জনদুর্ভোগের রাজনীতির কিছুটা হলেও অবসান হতে পারে। ‘রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন’ শুধু বক্তব্য দিয়ে হবে না, ছোট ছোট সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে করতে হবে। টিভি চ্যানেলে রাজনৈতিক জনসভার সম্প্রচার সে রকম একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে।

র‌্যাব ও সাংবাদিকতা
১৪ মার্চ প্রথম আলোতে র‌্যাবের কয়েকজন সদস্যের ডাকাতির অভিযোগ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বোধ হয় একেই বলে ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’। প্রথম আলোর মতো একটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্র সব তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত না হয়ে এমন একটি খবর প্রকাশ করবে না বলেই আমার বিশ্বাস। র‌্যাব কর্তৃপক্ষ এই খবরের প্রতিবাদ করেছে (১৫ মার্চ)। তারা বলেছে, ‘এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হলে তা সার্বিকভাবে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর মনোবলকে ক্ষুণ্ন করতে পারে। এ অবস্থায় একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর মনোবল ও ভাবমূর্তি যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনা করে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’
কোনো পত্রিকায় কোনো ‘বাহিনী’ বা কোনো ‘পেশার’ দু-একজন ব্যক্তির অপকীর্তি ছাপা হলে তা ওই বাহিনী বা পেশাকে কোনোভাবেই কলঙ্কিত করে না। সবাই জানেন, মানুষের মধ্যেই ‘অমানুষ’ লুকিয়ে থাকে। তারা সংখ্যায় খুবই কম। যুগে যুগে সংবাদপত্রে শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা প্রমুখ অত্যন্ত সম্মানজনক পেশার এবং পুলিশ, সেনাসদস্য, র‌্যাবের সদস্য, সাংবাদিক প্রমুখ অত্যন্ত দায়িত্বশীল পেশার বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তির অপকীর্তি সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে সংখ্যায় তা খুবই নগণ্য। এ ধরনের সংবাদ প্রকাশের কারণে এসব পেশার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বা আস্থা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন হয়েছে, এমন কথা কেউ বলেননি।
শুধু র‌্যাব কেন, যেকোনো পেশার আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমালোচনার জন্য সংবাদপত্রের এ ধরনের খবর একটা বড় ভূমিকা পালন করে। র‌্যাবের প্রতি অনুরোধ, সংবাদপত্রকে তার দায়িত্ব পালন করতে দিন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.