ভিন্নমত-মূল্যস্ফীতি রোধের বর্তমান কৌশল কোনো কাজে আসবে না by আবু আহমেদ

যে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবির, যে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী, যে অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দূর করার জন্য আমদানির ওপর ট্যাক্স আরোপসহ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সে অর্থনীতি অবশ্যই চাপের মুখে থাকবে এবং সেই অর্থনীতিতে মূল্যবৃদ্ধিটা হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

কিন্তু অর্থনৈতিক সূচকগুলো কেন পেছনের দিকে যাচ্ছে সে ব্যাপারেই নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। বাজার অর্থনীতি চলে আস্থা ও আশাবাদের ওপর ভর করে। গত দেড় বছরে বেশ কিছু কারণে আস্থা ও আশাবাদ দারুণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রথমে হয়েছে ভুল অর্থনৈতিক কৌশলের কারণে। সেই ভুলের মধ্যে অন্যতম ছিল, সংকোচনশীল মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যাংকিং সিস্টেমে কম মুদ্রার প্রাপ্ততার ব্যবস্থা করা। অর্থ প্রাপ্তিকে কঠিন করার ফল হয়েছে সুদের হারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। মাত্র এক বছরের মধ্যে অর্থনীতিতে মেয়াদি আমানতের সুদের হার বেড়ে ১২ থেকে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর ঋণ প্রদানের হার ১৮ থেকে ২০ শতাংশে পৌঁছেছে। একটা কথা অনেক আগ থেকেই শুনতাম, সেটা হলো, ব্যাংকগুলোতে স্প্রেড হার বেশি। স্প্রেড হলো আমানত নেওয়া ও ঋণ দেওয়ার সুদের হারের মধ্যে পার্থক্য। এই হার আগেও কমেনি, এখনো কমছে না। এই হার ৪ থেকে ৫ শতাংশ। যেটা আমাদের মতো অন্যান্য অর্থনীতির তুলনায় অবশ্যই বেশি। অন্য অনেক অর্থনীতিতে ঋণের সুদের হারই আমাদের ব্যাংকিং খাতের স্প্রেডের সমান! যা হোক, এই স্প্রেড নতুন করে ব্যাংকের অনুমোদন দিয়ে কমানো যাবে না। নতুন ব্যাংক অর্থনীতিতে প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কোনো দেশেই রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয় না। বাংলাদেশ যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক দেওয়া শুরু করে তাহলে এ প্রক্রিয়ার শেষ হবে না। বলছিলাম, সংকোচনশীল মুদ্রানীতি দ্বারা মূল্যস্ফীতি রোধের কথা। এই নীতি অনুসরণ করা হয় সাধারণ পূর্ণ নিয়োগকৃত উন্নত অর্থনীতিগুলোতে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এই মুদ্রানীতি অনুসরণ করলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। অর্থ প্রাপ্তি তো কঠিন হলো। কিন্তু ফল কী হলো? ফল হলো, সুদের হারের অতি বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা। অন্য আরেকটি ক্ষেত্রেও সংকোচনশীল মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়, সেটি হলো, অর্থনীতি যখন উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে গিয়ে অতি উচ্চস্ততিত হয়। আমাদের অর্থনীতি সে রকম উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে কখনো যায়নি। ৬ থেকে ৬.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার এখন আফ্রিকার অনেক দেশই অর্জন করছে। বরং বাংলাদেশ অর্থনীতি তার সম্ভাবনার অনেক নিচে অর্জন করছে। এই অবস্থায় সংকোচনশীল মুদ্রানীতি আমাদের অর্থনীতিকে পেছনে ঠেলে ধরে প্রকৃত অর্থে মূল্যস্ফীতিকেই কেবল বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকার ভর্তুকি হ্রাসের নামে অনেক উপাদানের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পেট্রল অন্যতম। আমাদের অর্থনীতিকে ভর্তুকি কমানো দরকার আছে কিন্তু সেই ভর্তুকি কমাতে গিয়ে এটাও দেখা উচিত, এসব বৃদ্ধি জনজীবনকে কিভাবে আঘাত করছে এবং এই বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়কেও কিভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক কি শুধু অর্থপ্রাপ্তিকে কঠিন করে মূল্যস্ফীতি রোধ করতে পারবে? যে সব নীতি-কৌশল আজকে গ্রহণ করা হচ্ছে, এগুলো অর্থনীতির জন্য কেবলই কাউন্টার প্রডাকটিভ। ভর্তুকি যদি হ্রাসই করতে হয় তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস যে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসানের মাধ্যমে হজম করে চলেছে সেসব ক্ষেত্রেই তো ওই ভর্তুকি হ্রাস করার দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। অন্য একটি কথা অতি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই। বাংলাদেশ একা চলতে পারবে না। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অতিমাত্রায় ভারতনির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে বাংলাদেশ একতরফাভাবে ভারতকে শুধু সুযোগগুলো দিয়েই চলেছে। ভারত থেকে পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাচ্ছে অতি নগণ্য। আজকে যে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যরা এই দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, সেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পেছনে শুধুই কি দুর্নীতি কাজ করেছে? অন্য অনেক দেশই বর্তমানের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে খুশি নয়। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আরো সংকুচিত হতে পারে। আগামী বাজেট মেলানোই অর্থমন্ত্রীর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। বলা হচ্ছে, বিদেশি প্রাইভেট পুঁজি দিয়ে পদ্মা ব্রিজ অর্থায়ন করা হবে। কিন্তু সেই প্রাইভেট পুঁজির ভার কত? আশা করি, সরকার এ ক্ষেত্রে অর্থনীতির ইস্যুগুলোকে অতি ভালোভাবে বিবেচনায় আনবে। আজকে অর্থনীতিতে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে তার অন্য কারণ হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। রাজনৈতিক সংঘাত রাজনীতিবিদদেরই সমাধান করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা হলো মুখ্য। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে উন্নয়ন-অগ্রগতিসহ সব কিছুই ব্যাহত হবে এটাই খুব স্বাভাবিক। কাজেই রাজনীতিকদের এক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব অনেক বেশি।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.