দিল্লির চিঠি-দুর্নীতিতে কংগ্রেস-বিজেপি সমানে সমান by কুলদীপ নায়ার

ভারতের সফট্ওয়্যার শিল্পের কেন্দ্রস্থল বেঙ্গালুরু। সেখানে ঢোকামাত্র আপনি দুর্নীতির দুর্গন্ধ টের পেতে শুরু করবেন। খোলামেলাভাবে দুর্নীতির বিষয়ে সবাই কথা বলে। যেকোনো বৈঠকে বসলে আপনি মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদ্দুরাপ্পার অসাধু কর্মকাণ্ডের কথা শুনবেন। গভর্নর এইচ আর বরদ্বাজ হয়তো দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিও মিশিয়ে নিচ্ছেন।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর শাসন যে নোংরামিতে ভরে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে অংশগ্রহণ এবং লোকপাল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমর্থনদানের সময় বিজেপি যখন কংগ্রেস সরকারের কেন্দ্রীয় ও রাজ্যপর্যায়ে দুর্নীতি আড়াল করার দ্বিমুখী নীতি গ্রহণকে আক্রমণ করে, তখনো বিজেপির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
কয়েক দিন আগে আমি বেঙ্গালুরুতে ছিলাম। লোকসভায় বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজ তখন এক বিবৃতিতে বলেন, বেলারি ভাইদের রাজনীতিতে আনার পেছনে তাঁর কোনো হাত নেই। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী হিসেবে তাঁদের নিয়োগের বিরোধী ছিলাম আমি। একই পরিবারের তিনজন মন্ত্রী হবে, সেটা চাইনি। কিন্তু সেই ভাইদের মন্ত্রী বানানোর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল তাঁদের (অরুণ জেটলি, ইয়েদ্দুরাপ্পা ও অনন্ত কুমার)।’ সুষমার এ ভাষ্যের বিরোধিতা পাওয়া যায় বিজেপিপ্রধান নিতিন গড়করির বক্তব্যে। এ বিষয়ে গড়করি রাজ্যসভায় বিরোধীদলীয় নেতা অরুণ জেটলিকে সমর্থন করেন।
বিজেপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ কোনো খবর নয়। ঘটনাটির জন্য কে দায়ী—সুষমা স্বরাজ নাকি অরুণ জেটলি, সেটা দলের অভ্যন্তরীণ মামলা। তবে আমার দুশ্চিন্তা এই বিবাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েই। সুষমা-জেটলির ‘তুই-তুই, আমি-আমি’ কলহ দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার একটি দিক মাত্র। কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় আর সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া যায়, সেই নোংরা রাজনীতিই যে শাসন পরিচালনার মূল উদ্দিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজ্যের শেষ তিনটি উপনির্বাচনের কথাই ধরুন। তিনটিতেই জিতেছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদ্দুরাপ্পা নিজে তিন কংগ্রেসদলীয় সদস্যকে তাঁদের দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আয়োজন করলেন এবং তাঁদের পদত্যাগ করিয়ে নিলেন। পক্ষত্যাগবিরোধী আইনে সে রকমই ব্যবস্থা। তারপর অর্থ ও রাষ্ট্রযন্ত্র কাজে লাগিয়ে তাঁদের পুনর্নির্বাচনও নিশ্চিত করালেন। পুরো ব্যবস্থা যে কতটা কদর্য রূপ পেয়েছে, তা বোঝা গেল। গুজরাটেও একইভাবে আরেক বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেশির ভাগ গুজরাটির মগজ ধোলাই করে তাদের সাম্প্রদায়িক করে তুললেন। আর সরকারযন্ত্র ব্যবহার করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যায় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।
যদিও রেড্ডি ভাইদের উত্থানের জন্য জেটলিকে দুষেছেন বিজেপির নেতা সুষমা, কিন্তু এটা তো সবার জানা যে সুষমা ও রেড্ডিদের গাঁটছড়া বাঁধে ১৯৯৯ সালে, যখন বেলেরি আসনে কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সুষমা। আসলে রেড্ডিদের প্রতিপত্তি বাড়ার কৃতিত্ব সুষমারই। রেড্ডি ভাইয়েরা তো এখন নিজেরাই আইন হয়ে উঠেছেন।
রেড্ডি ভাইয়েরা ওবুলাপুরাম মাইনিং কোম্পানির মালিক। এ কোম্পানির বিরুদ্ধে অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকে ভূমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। তাদের কার্যসাধন পদ্ধতি হলো, অন্ধ্রপ্রদেশে খননকাজের অনুমতি নিয়ে সেটা কাজে লাগিয়ে পার্শ্ববর্তী কর্ণাটকে অবৈধ খননকাজ চালানো। ঘুষের মাধ্যমে সরকারযন্ত্র ও প্রশাসনের পরোক্ষ সম্মতি আদায় করে তারা এ কাজটি করছে। এমনকি রেড্ডি ভাইদের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে লোকযুক্ত বিচারপতি সন্তোষ হেগের প্রাথমিক প্রতিবেদনেরও কোনো প্রভাব পড়েনি রাজ্য সরকারের ওপর।
রাজ্য লোকযুক্ত এখনো রেড্ডিদের অপকর্মের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দ্বিতীয় প্রতিবেদন শিগগিরই জমা দেওয়ার কথা। সূত্রমতে, প্রতিবেদনটিতে রেড্ডি ভাইদের নাম আসতে বাধ্য। প্রতিবেদনে হয়তো বিজেপি অথবা এর নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ নিয়ে কিছুই প্রকাশিত হবে না, তবে নিশ্চিতভাবে রেড্ডি ভাইদের নাম আসবে।
অবশ্য এরই মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, রেড্ডি ভাইদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বিজেপি। বিশেষত, রেড্ডিদের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী শ্রীরামুলু একটি বিবৃতি দেওয়ার পর দূরত্ব বাড়ছে। খবরে প্রকাশ, মন্ত্রী বলেছেন: ‘সুষমা হয়তো রাজনৈতিক কারণে আমাদের অস্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাজনীতির ঊর্ধ্বে। আমরা তাঁকে মায়ের মতো মনে করি। তাঁর সন্তান হিসেবে তাঁর প্রতি আমরা কখনো রাগ করব না...।’ তাঁর এ বক্তব্য দিল্লির বিজেপি নেতৃত্বের জন্য হয়তো আরও সমস্যা তৈরি করবে।
রেড্ডির শিবির থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এর কারণও বোধগম্য। অন্যদিকে বিজেপির সভাপতি গড়করির হুকুমের ব্যাপারেও বাহ্যত নীরবতা বজায় রেখেছেন রেড্ডিরা। তিন ভাইয়ের অন্যতম ও রাজ্যের রাজস্বমন্ত্রী জি করুনাকারা রেড্ডি বলেছেন, ‘গড়করির নির্দেশে আমি নীরবতা পালন করছি। আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
রেড্ডি ভাইয়েরা অথবা মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদ্দুরাপ্পা সরকার থেকে পদত্যাগে বাধ্য হবেন কি না, সেটা এখনো জল্পনা-কল্পনার ব্যাপার। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার, বিজেপি কর্ণাটকে দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের ততটাই সমর্থক, যতটা অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দ্রে কংগ্রেস। সুঁই যদি চালনির ছিদ্র দেখাতে যায়, তাতে কি উপকার হয়!
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.