গতকাল সমকাল-পারস্যে রবীন্দ্রনাথ আর আমার উপলব্ধির ইরান by ফারুক চৌধুরী

২৭ মে থেকে ২ জুন ২০১১—পাশ্চাত্যের জারি করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাধীন ঐতিহ্যবাহী ইরানের তেহরান আর ইস্ফাহান শহর দুটিতে সপ্তাহ খানেক কাটিয়ে দেশে ফিরেছি। ব্র্যাকের প্রতিনিধি হিসেবে ইমাম খোমেনি ত্রাণ ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে ছিল সফরটি।
সফরকালে ব্র্যাকের সভাপতি ফজলে হাসান আবেদ ইমাম খোমেনি ত্রাণ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার হোসেন আনভারির সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্র্যাক ও খোমেনি ফাউন্ডেশনের মধ্যে সহযোগিতার একটি স্মারকপত্র স্বাক্ষর করলেন। এই নিবন্ধটির বিষয়বস্তু কিন্তু ব্র্যাক, খোমেনি ফাউন্ডেশন, দারিদ্র্য বিমোচন অথবা নারীর ক্ষমতায়ন নয়। এই নিবন্ধটি লিখেছি ইরান সফরে আমার কিছু ব্যক্তিগত আগ্রহ আর ভাবনাকে কেন্দ্র করে।
১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ নৃপতি রেজা শাহ পাহলভির (বিতাড়িত শাহেনশা মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির পিতা) আমন্ত্রণে সফর করেছিলেন ফেরদৌসি, হাফিজ, সাদি আর খৈয়ামের আবাসভূমি, আধুনিকায়নরত পারস্য। আমার সফর ছিল প্রয়াত, কিন্তু সর্বত্র দৃশ্যমান ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির অযুত প্রতিকৃতির নেক নজরের বেষ্টনীতে আয়াতুল্লাহ খোমেনি আর আহমাদিনেজাদের রক্ষণশীল, টানটান উত্তেজনাময় দৃঢ়সংকল্পের ইরানে। রবীন্দ্রনাথের সফরের সময় পারস্য তার ঐতিহ্যের ভান্ডার নিয়ে বেশ কিছুটা যুক্তরাষ্ট্রমুখী ছিল। বর্তমানে আমার দেখা ইরানের চোখে যুক্তরাষ্ট্র ‘মহা শয়তান’ আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইরান ‘কুচক্রীদের মধ্যমণি’।
ইরান যাব স্থির হওয়ামাত্রই চলে গেলাম বইয়ের সেলফে রাখা রবীন্দ্র রচনাবলিতে। ইরান সফরের প্রস্তুতি হিসেবেই প্রথমবারের মতো পড়লাম তাঁর ‘পারস্যে’ প্রবন্ধটি। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘দেশ থেকে বেরবার বয়স গেছে এইটেই স্থির করে বসেছিলুম।’ কিন্তু ‘পারস্য রাজ্যের’ নিমন্ত্রণ ‘অস্বীকার’ করা যে ‘অকর্তব্য’ হবে। চতুর্দশ শতাব্দীতে পারস্যের কবি হাফিজ বাংলাদেশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সোনারগাঁ থেকে পাঠানো দাওয়াত রাখতে না পেরে প্রতিদানে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। এখানকার তোতাপাখি, পারস্যের মিষ্টি আর সুলতান গিয়াসউদ্দিনের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা বলে। কবিতাটি দেওয়ান-ই-হাফিজ অলংকৃত করছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে হাফিজের সোনারগাঁ না আসতে পারাটা সহজেই অনুমেয়। সুদীর্ঘ সময় লেগে যেত আসা-যাওয়ায়। কিন্তু ১৯৩২ সালের ১১ এপ্রিল তাঁর সর্বশেষ বিদেশ সফরে (১৯৩৪ সালের শ্রীলঙ্কা সফরকে কি বিদেশ সফর বলা যায়?) রবীন্দ্রনাথ (লন্ডন-প্যারিস সংক্ষিপ্ত বিমান সফর একটি বাদ দিলে) আকাশপথে তাঁর একমাত্র দীর্ঘপাল্লার সফরে একটি কেএলএম ব্যোমযানে চেপে কলকাতার দমদম থেকে ‘বাংলাদেশের মাটির টান কাটিয়ে নিজেকে শূন্যে’ ভাসিয়ে দিলেন। প্রথম যাত্রাবিরতি এলাহাবাদে, যেখানে তাঁর ‘যন্ত্রটা পেট ভরে তৈল পান করে নিলে’। কানে তুলো দিয়ে প্লেনে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ, আর ‘ক্ষুদ্র এক টুকরো-সজনতা নিচের পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ে উড়ে চলেছে অসীম জনশূন্যতায়’।
তারপর আমাদের ৭০ বছর বয়সের (ফজলে হাসান আবেদ আর আমার বয়স যথাক্রমে ৭৫ আর ৭৭) ক্লান্ত ‘বায়ু-তরী যাত্রী’ কবির রাত্রিবাস ভারতের রাজস্থানের যোধপুরে। অতঃপর বর্তমান পাকিস্তানের তালেবান আক্রান্ত করাচি, যেখানে কবি ‘বাঙালি গৃহলক্ষ্মীর সযত্নপক্ব অন্ন ভোগ করে’ আধঘণ্টার মধ্যে জাহাজে উঠে পড়লেন। ‘বাতাস মেতে উঠল। ডাঙায় বাতাসের চাঞ্চল্য নানা পদার্থের ওপর আপন পরিচয় দেয়। এখানে তার একমাত্র প্রমাণ জাহাজটার ধড়ফড়ানি।’ অবশেষে পারস্যে ‘জাস্ক’ বলে একটি ‘ইতস্তত বিক্ষিপ্ত’ মাটির কিছু ছোট বাড়ি সমন্বিত একটি গ্রামে ‘আকাশযাত্রীদের পান্থশালায়’ রাত কাটিয়ে পরদিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল পারস্যের বন্দরনগর বুশায়েরে পৌঁছালেন রবীন্দ্রনাথ। রাজ-অতিথি রবীন্দ্রনাথ। তাই ‘সম্মানের সমারোহ এসে অবধি নানা আকারে চলছে’। আকাশপথ যাত্রার ইতি ‘বুশায়েরেই। তারপর ১৬ এপ্রিল ১৯৩২-এ মেঠো রাস্তায় মোটরযোগে বুশায়ের থেকে শিরাজ। ‘মোটরগাড়ির চালচলনের সঙ্গে রাস্তাটার ভঙ্গিমার বনিবনাও নেই।’ এই ‘অসামঞ্জস্যের ধাক্কা’ অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ‘হাড়ে হাড়ে’ যুঝেছিলেন ৭০ বছরের রবীন্দ্রনাথ। রাজ-অতিথি রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জানালেন সেই প্রদেশের গভর্নর। শিরাজে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া কবি শেখ মুসলেহ উদ্দিন সাদি। শিরাজেরই সন্তান সাদি। সাদির সমাধিতে স্থাপত্যের গুণপনা কিছুই নেই। আজকের মতো ফুল দিয়ে প্রদীপ দিয়ে সাজানো সমাধির পশ্চাতেই বৃহৎ জনসভায় রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জানানো হলো। শিরাজে আরও শায়িত রয়েছেন বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের দাওয়াতে সোনারগাঁয়ে আসতে না পারা ১৩১৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মানো গজল-সম্রাট শামসুদ্দিন মোহাম্মদ হাফিজ। হাফিজের সমাধির পাশে বসে বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথের মনের মধ্যে ‘...এসে পৌঁছাল এখানকার এই বসন্ত প্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হলো, আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা-রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি।’ তারপর রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘নিশ্চিত মনে হল আজ, কতশত বছর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে, যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’ শিরাজের কবি হাফিজ না-ই বা আসতে পারলেন সোনারগাঁয়ে। হাফিজের ‘চিরকালের জানা লোক’ রবীন্দ্রনাথ ছয় শতক পরে গিয়ে হাজির হাফিজের সমাধিতে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বঙ্গাধিপতি একদা কবি হাফেজকে বাংলায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তিনি যেতে পারেননি।
বাংলার কবি পারস্যাধিপতির নিমন্ত্রণ পেলে, সে নিমন্ত্রণ রক্ষাও করলে আর পারস্যকে তার প্রীতি ও শুভকামনা প্রত্যক্ষ জানিয়ে কৃতার্থ হল।’ একটি সাক্ষাৎকারে ইসফাহান পত্রিকার সম্পাদককে রবীন্দ্রনাথ জানালেন, হাফিজের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচিতি তাঁর পিতার মাধ্যমে যিনি হাফিজের কবিতা আবৃত্তি করে তাঁকে শোনাতেন। ইরানের সাংসদ দাশতির সঙ্গে আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ছেলেবেলায় বাংলাদেশে স্বগৃহে ইরানের ‘জ্যান্ত প্রভাব’ তিনি উপলব্ধি করতেন এবং তাঁর পিতা আর জ্যেষ্ঠ সহোদররা পারসিক সাহিত্য এবং শিল্পকর্মের গভীর অনুরাগী ছিলেন। পারস্যে অবস্থানকালে সেখানকার শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ একটি কথার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তা হলো, ইউরোপ একটি মহাদেশীয় সংস্কৃতি উদ্ভব করতে সমর্থ হয়েছে, যেখানে ইউরোপের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিজ নিজ অবদান রাখছে। এই সহযোগিতা ইউরোপকে মহান করে তুলেছে। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি এই ছিল যে, এশিয়ায় ও মহাদেশীয় সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে সাহিত্যে, শিল্পে, বিজ্ঞানে ও দৈনন্দিন জীবনে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়ায় আর তা প্রকাশ করার।
আট দশক আগেকার রবীন্দ্রনাথের পারস্য অর্থাৎ আমাদের ইরানকে খুঁজে বের করার অবকাশ আমাদের হালের সফরে ছিল না—সে কথা যেমন ঠিক তেমনি সত্যি এই কথাটিও যে ঐতিহ্যবাহী ইরানে পুরাতনের মাঝে চিরন্তনকে আবিষ্কার করা খুব দুষ্কর নয়। দশম শতাব্দীর শুরু থেকে বর্তমান কালের সব স্থাপনা, যথা মসজিদ, মিনার, সেতু; প্রকৃতিদত্ত উদ্যানরাজি, বনভূমি, পাহাড়ের স্তর, অথবা শহরের মধ্যে বিরাটাকার উন্মুক্ত স্কয়ার; আগে যেমন ছিল তেমনি আছে। তেমনি আছে গ্রীষ্মের প্রাক্কালে শহর ঘিরে থাকা গিরিচূড়ায় অপস্রিয়মাণ তুষার, যা রবীন্দ্রনাথের কাছে গিরিরাজির ললাটে শুভ্র তিলকের মতো মনে হয়েছিল। তেমনি আছে মসজিদের চূড়া, ‘যেন নীলপদ্মের কুঁড়ি’, সুচিক্বণ নীল পারসিক টালি দিয়ে তৈরি, এই সকালবেলাকার পাতলা মেঘে ছোঁয়া আকাশের চেয়ে ঘনতর নীল। তেমনি রয়েছে বাংলা ভাষায় পরিচিত-অর্ধপরিচিত শত শত ফারসি শব্দ; যথা—আদালত, হাকিম, পেশকার, আবহাওয়া, নাজির, ওকালতনামা, আরজি, দস্তখত, জমিন, সেরেস্তাদার, মেহমান, দোস্তি, গোসল, খোদা হাফেজ ইত্যাদি—ফর্দটিকে দীর্ঘতর করা মুশকিল নয় মোটেও।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও আট দশক পরের পারস্য তথা ইরানকে এখন চিনতে রবীন্দ্রনাথের বেগ পেতে হতো বিস্তর। ইরানে কাটানো রবীন্দ্রনাথের বসন্তের সঙ্গে বর্তমানের রাজনৈতিক আরব বসন্তের মিল কোথায়? রবীন্দ্রনাথ রেজা শাহ পাহলভি ও তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার প্রশংসা করেছিলেন। রাজনীতির এমনই বিধান যে, তা এখন একেবারেই অবান্তর। রবীন্দ্রনাথ ফিলিস্তিনে আরব আর ইহুদিদের যে শান্তিময় সহাবস্থান কামনা করেছিলেন তা আজ সুদূরপরাহত। এখন ইরানের দৃষ্টিতে ইসরায়েল ‘মহা শয়তান’ যুক্তরাষ্ট্র-সৃষ্ট ‘ছোট শয়তান’ আর আয়াতুল্লাহ খোমেনির ভাষায় একটি ক্যানসারাক্রান্ত টিউমার। প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ তাঁর সুললিত ফারসি ভাষায় কামনা করেছেন যে, জেরুজালেমের দখলদার শক্তি ‘সময়ের পাতা থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাক’। এদিকে ইসরায়েলের এহুদ বারাক রক্ত হিম করা ভাষায় নির্বিকারে বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ‘সরাসরি আঘাত হানা অবশ্যই একটি বিকল্প সম্ভাবনা’।
এবারকার আমার ইরান সফরের প্রধান উপলব্ধি এই যে, মধ্যপ্রাচ্যের গণজাগরণ অতীতের অনেক সমীকরণই আমূল পাল্টে দিয়েছে। আরব গণজাগরণের প্রক্রিয়া আর পার্শ্বপ্রক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করার সময় আসতে এখনো অনেক বাকি। তবে কিছু কথা বোধ করি দূরদৃষ্টিতে বলাই যায়। প্রথম হলো, পশ্চিমের মরক্কো থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মাঝখানে অবস্থিত মিসর হয়ে পূর্বপ্রান্তের ইরান (আফগানিস্তান আর পাকিস্তানকে আপাতত বাদ দিচ্ছি) একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে রয়েছে। তা হলো, সেসব দেশের পরিচালনায় সম্পৃক্তির দাবি নিয়ে জনগণের সংগ্রাম। বিভিন্ন দেশে সেই সংগ্রামের অবস্থা ভিন্ন। অনেক দেশে দৃশ্যত সেই সংগ্রামের সূচনাই হয়নি—যেমন সৌদি আরব। তবে আরব-বসন্তসংগীতের রেশ যে সে দেশের সাধারণ মানুষের কানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখানে ভুললে চলবে না যে, ৯/১১-এর হোতাদের সিংহভাগই ছিলেন সৌদি নাগরিক। ভুললে চলবে না যে, আল-কায়েদার কর্ণধার, ‘দুর্বিনীত নৃশংস’, ‘মহাপ্রলয়ের নটরাজ’ ওসামা বিন লাদেন ছিলেন সৌদি আরবের একটি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। দ্বিতীয় হলো এই যে, পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের বশংবদদের নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ঘর সাজানোর দিন বুঝি শেষ হয়ে এল। ইরান নিয়ে নতুন একটি মধ্যপ্রাচ্য জাগছে ও জাগবে। এক অর্থে ইরান বর্তমান আরব গণজাগরণের অংশ নয়। সেই দেশে ব্যক্তিতন্ত্র নয়, রয়েছে মোল্লাতন্ত্র। পাশ্চাত্যের প্রচলিত মূল্যবোধে (যে মূল্যবোধ বাক-স্বাধীনতার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ভিনদেশে প্রাণনাশী ড্রোন বিমান আক্রমণ চালায়) সেই দেশে বাক-স্বাধীনতা নেই, তবে নির্মম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি রয়েছে মাথা উঁচু করে বাঁচার অদম্য সংকল্প। তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে ইসরায়েলকে একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের মোকাবিলা করতে হতে পারে, বোঝাপড়া করতে হতে পারে একটি সার্বভৌম, বহুলাংশে পাশ্চাত্য প্রভাবমুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে। চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে শিয়া, সুন্নি আর খ্রিষ্টানদের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করার যে অপচেষ্টা চলছে, তা হয়তো বা সফল হবে না। পঞ্চমত, ইরান বাহরাইনে বহিরাগতদের সামরিক হস্তক্ষেপের কঠোর নিন্দা জানিয়ে, সিরিয়ার প্রতি একটি সতর্ক ও সাবধান নীতি অনুসরণ করে এবং মিসরের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে, ‘আমরাও আছি।’
মিসর আর ইরানের মধ্যে নীতিগত তফাত ছিল পরস্পরবিরোধী। যেমন—মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সই করেছে, স্বীকৃতি দান করেছে আর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে শাহানশাহের ইরানেরও ছিল সহযোগিতার সম্পর্ক। তবে ইরানের অযোধ্যায় এখন সমাসীন অন্য রাম। এই ইরান সেই ইসরায়েলকে মানেই না। মিসর আর ইরানের সম্মিলিত জনসংখ্যা ১৫ কোটি। সম্মিলিত আয়তনে দেশ দুটি যেন একটি মহাদেশ। সম্মিলিত জিডিপি ৫২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মধ্য আয়ের সম্ভাবনাময় দেশ ইরান আর মিসর। অন্যদের (যথা—সিরিয়া) বাদ দিলেও ইসরায়েলকে সাবধানেই কথা বলতে হবে। ‘মহা শয়তানের’ যত্রতত্র অবাধ বিচরণ আর সম্ভব না-ও হতে পারে। অতএব ‘ছোট শয়তানের’ সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
তেহরানের খোমেনি বিমানবন্দরে অবতরণ করে অভ্যর্থনাকারীদের সংস্পর্শে আসতেই বোঝা যায় যে তাঁরা একটি শিক্ষিত, মার্জিত এবং ঐতিহ্যবাহী সমাজের প্রতিনিধি। অতিথিপরায়ণতায় ইরানিদের জুড়ি নেই। তাঁদের রন্ধনশৈলী অপূর্ব। হরেক রকম আর স্বাদের কাবাব, মুক্তার দানার মতো সাদা আর পাখির পালকের মতো হালকা, সুস্বাদু পোলাও, ইরানি কামে (অর্থাৎ কিমা), খোরশে আনার (আনারের তরকারি), নারাংএ খোরশে (নারাঙ্গি অর্থাৎ কমলালেবু আর মাংসের তরকারি)—আরও কত কী! ঐতিহ্যবাহী ইরানের স্থাপত্য চোখধাঁধানো। ভারতের মোগল সম্রাটেরা তার অনুকরণে দ্বিধা করেননি। তাজমহলের স্থপতি ছিলেন ইরানেরই। ইরানি রমণীরা অফিস-আদালতে, কারখানায় কর্মব্যস্ত। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মহিলারা বোরকা পরেন, তবে অধিকাংশ মহিলার পরিধানে মুখমণ্ডল অনাবৃত হেজাব। ইস্ফাহানের ছায়াঢাকা পথে, শ্যামল উদ্যানে, দৃষ্টিনন্দন স্কয়ারে, ঐতিহাসিক স্থাপনায় ইরানি মহিলাদের উপস্থিতি যেন সুন্দরের সমারোহ। ধর্মযাজকদের শিরাভরণ বাদ দিলে, পুরুষের মাথায় নেই টুপি, তবে গলায় নেই টাই। নামাজিরা সাধারণত জোহর, আসর আর মাগরিব-এশাকে একসঙ্গে মিলিয়ে গৃহীত শিয়া প্রথায় দিনে নামাজ তিনবার পড়েন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে ইরানের মোল্লাতন্ত্র উদারপন্থী, কিন্তু সরকার-নির্ধারিত নীতি পালনের বাধ্যবাধকতায় কঠোর। আমার দেখা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ইরান নিঃসন্দেহে শীর্ষে। ফারসি ভাষা এতই মধুর যে না বুঝলেও শুনতে মন চায়।
রবীন্দ্রনাথের পারস্য আর আমাদের ইরান এক নয়, সে কথা ঠিক। তবে ইস্ফাহানের চিরন্তনাকে উল্লেখ না করে লেখাটির সমাপ্তি টানতে পারছি না। সংক্ষেপে একটি কথাই বলব। পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন আর ঐতিহ্যবাহী শহরগুলোর যেকোনো মণিহারে ইস্ফাহান মধ্যমণির ঔজ্জ্বল্যেই বিরাজ করবে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net

No comments

Powered by Blogger.