বিশ্ব খাদ্য দিবস-চাই ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী by হোসে গ্রাজিয়ানো দা সিলভা

গত দশকগুলোয় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সামপ্রতিক একটি প্রতিবেদনে এ অঞ্চলব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে নাটকীয় অগ্রগতি অর্জনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৮১ সালে এশীয়দের ৭৭ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করত কিন্তু ২০০৮ সাল নাগাদ এ অনুপাত দাঁড়ায় কেবল ১৪ শতাংশে।

তা সত্ত্বেও বিশ্বের প্রতি তিনজন ক্ষুধার্ত লোকের মধ্যে দুজনই বাস করে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বিশ্বের পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ এ অঞ্চলে বাস করে। এর অর্থ, প্রায় অর্ধ বিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত।
২০৫০ সাল অবধি পরবর্তী দশকগুলোতে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্য চ্যালেঞ্জ হলো ত্রিমুখী: ক্ষুধা নির্মূল করা এবং প্রত্যেকের খাদ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা; জলবায়ু পরিবর্তন ও ত্বরিত নগরায়ণ সত্ত্বেও কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি করা; এবং একটি পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই পদ্ধতিতে এ কাজগুলো সম্পন্ন করা।
বর্তমান থেকে শুরু করে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে আনুমানিক দুই বিলিয়ন অতিরিক্ত মানুষের মুখে খাবার জোগানোর জন্য যে খাদ্যের প্রয়োজন, তা মেটাতে হলে চাষের নতুন নতুন ক্ষেত্রের প্রসার ঘটানোর চেয়ে বিদ্যমান জমিতে ছোট ছোট খামারভিত্তিক কৃষিকাজ বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে। নাজুক পরিবেশব্যবস্থা ও সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদকে আর বেশি বিপদাপন্ন না করে উপরিউক্ত কাজ করতে হলে প্রয়োজন বিভিন্ন নতুন এবং টেকসই পদ্ধতি।
তবে আরও খাদ্য উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ হলেও যথেষ্ট নয়। বিশ্বে ইতিমধ্যে যথেষ্ট খাবার রয়েছে এবং তথাপি ৯২৫ মিলিয়ন মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। ক্ষুধার প্রধান কারণ হলো: খাবার পাওয়ার জন্য সুযোগ-সুবিধার অভাব। স্থানীয় পর্যায় থেকে সমস্যাটির প্রধান দিক বিবেচনা করলে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় যে মানুষের কাছে খাবার কেনার টাকা রয়েছে বা তারা তাদের নিজেদের ও পরিবারের জন্য যথেষ্ট খাদ্যও উৎপাদন করতে পারে। ক্ষুধা হয়তো একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে মানুষ খাবার খায় তাদের বাড়িতে, তাদের নিজেদের শহরে এবং গ্রামে।
এর অর্থ, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন ছোট আকারের খামারের মালিকদের সহায়তা প্রদান করা, যাতে তাঁরা টেকসইভাবে বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে পারেন এবং তাঁদের উৎপাদিত খাদ্য বাজারজাত করার সুবিধা পান; নগদ অর্থ স্থানান্তর-ব্যবস্থা ও কাজের বিনিময়ে নগদ অর্থ প্রদানের কর্মসূচি; গ্রাম অঞ্চলে জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাদি রাখা, যার ফলে মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে, তাদের সন্তানেরা ভালোভাবে খেতে পারবে এবং স্কুলে যেতে পারবে। সামাজিক ও উৎপাদনশীল নীতিমালার মধ্যে যোগাযোগ থাকতে পারে এবং তা থাকাও উচিত, যাতে এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যের ব্যবহার ও উৎপাদন পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এমন একটি জোরালো ও কার্যকর আবর্ত তৈরি করা যায়।
বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক খাদ্য সমতার ক্ষেত্রে আরেকটি বিবেচ্য দিক হলো, খাদ্যের ব্যবহার। এ পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রতি দুজন ব্যক্তির মধ্যে প্রায় একজন হয় যথেষ্ট খেতে পারছে না বা নিম্ন মানের খাবার খাচ্ছে অথবা খুব বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ করছে।
পৃথিবীর ৯২৫ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও এক বিলিয়ন মানুষ, যারা মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টজনিত ঘাটতিতে ভুগছে, আবার অপর দিকে আরেক বিলিয়ন মানুষ হয়ে পড়েছে অতিরিক্ত স্থূলকায়। সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর মানুষের ব্যবহারের জন্য পৃথিবীতে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয়, তার মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ, যার পরিমাণ আনুমানিক ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন, হয় স্রেফ ব্যবহারই হচ্ছে না বা নষ্ট হচ্ছে।
এ অপচয় রোধ করা গেলে খাদ্যের দাম কমে আসত, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ হ্রাস পেত এবং গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন সীমিত করা যেত এবং তার ফলে মানুষ আরও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনও করতে পারত।
অবশ্য এশিয়া বা প্রকৃত অর্থে বৈশ্বিক পর্যায়ে ক্ষুধা হতে মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত আন্তর্জাতিক প্রয়াস। হ্যানয়ে এই সপ্তাহে ৪০টি দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক ফাওয়ের ৩১তম আঞ্চলিক সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
ক্ষুধাসংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশেষ করে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলো অন্যান্য উন্নয়নশীল বা বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে প্রয়োগকৃত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সুফল অর্জনে সক্ষম হবে।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ যাবৎ ফাওয়ের ৪৭টি দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বিষয়ক চুক্তি বিদ্যমান। এই চুক্তিসমূহের আওতায় ১৩টি দেশের এক হাজার ৫০০-এরও অধিক বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি সহায়তা প্রদানকারী ব্যক্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী ৩৫টি দেশে তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান বিনিময় করছেন। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম।
বৈশ্বিক সমপ্রদায়ের একটি অংশ হিসেবে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জনগণ এ অঞ্চলের লক্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ত্বরিত সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ক্ষুধামুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় নিশ্চিত ভূমিকা পালন করতে পারে।
হোসে গ্রাজিয়ানো দা সিলভা: জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.