এক বছর পর সংসদে বিএনপি-অশালীন ভাষা, তির্যক বাক্য, হাতাহাতির উপক্রম

টানা এক বছর অনুপস্থিত থাকার পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের শরিকেরা গতকাল রোববার সংসদে যোগ দিয়েছে। যোগ দিয়েই বিরোধী দলের একজন নারী সদস্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পর্কে ‘অশালীন’ ভাষায় বক্তব্য দিয়ে সংসদে উত্তেজনা ছড়িয়েছেন।

এ নিয়ে উভয় দলের সদস্যদের মধ্যে তির্যক বাক্য বিনিময় ও দুই নারী সাংসদের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয়। এ সময় উভয় দলের চিফ হুইপ ও সাংসদেরা এসে তাঁদের নিবৃত্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া তখন সংসদে উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল রোববার বিকেল পাঁচটা ১২ মিনিটে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দল অধিবেশনকক্ষে প্রবেশ করে। সর্বশেষ গত বছর ২৪ মার্চ বিরোধী দল সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল।
ঘটনার সূত্রপাত হয় রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাব-সম্পর্কিত আলোচনায় বিরোধীদলীয় নারী সাংসদ রেহানা আক্তারের বক্তব্য নিয়ে। তাঁর বক্তব্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় স্পিকার আবদুল হামিদ অসংসদীয় বক্তব্যগুলো এক্সপাঞ্জ করার ঘোষণা দিয়ে আলোচনা সংক্ষিপ্ত করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কটাক্ষ: রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় রেহানা আক্তার বলেন, বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর নির্দেশে চলে না। বিএনপি চলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগই একসময় জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের পা ছুঁয়ে সালাম করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যের পর সংসদে সরকারদলীয় সাংসদেরা হইচই শুরু করেন।
রেহানা আক্তারের পেছনের সারিতে বসা সরকারদলীয় সাংসদ ফজিলাতুন্নেসা আঙুল উঁচিয়ে রেহানা আক্তারকে চুপ করতে বলেন। তিনি বলেন, ‘চুপ কর চুপ কর।’ এ সময় রেহানা আক্তারের পাশে বসা বিএনপির দুই নারী সাংসদ শাম্মী আক্তার ও সৈয়দা আশিয়া আশরাফি আওয়ামী লীগের সাংসদ ফজিলাতুন্নেসার দিকে তেড়ে যান। তাঁরা বাগিবতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং প্রায় হাতাহাতির উপক্রম হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, শহিদউদ্দিন চৌধুরী সিট থেকে উঠে এসে তাঁদের নিবৃত্ত করেন। এ সময় সরকারি দলের চিফ হুইপ আব্দুস শহীদসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগের সাংসদও সেখানে আসেন। তাঁরাও দলীয় নারী সাংসদদের সামলান।
রেহানা আক্তার তাঁর বক্তৃতায় আরও বলেন, রাষ্ট্রপতি দেশের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত ও বস্তাপচা বুলি। প্রধানমন্ত্রীর লিখে দেওয়া বক্তব্য কেবল তিনি পাঠ করেছেন। স্বরারষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, তাঁর বিশ্রী হাসি দেখলে মানুষ ভয়ে টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। তিনি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের কথা বললেও এক মাসেও সেই ৪৮ ঘণ্টা শেষ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসীদের গডফাদার। তাঁর আঁচলের নিচে খুনি-সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়। তারেক রহমানকে ফাঁসাতে বিদেশ থেকে সাদা চামড়ার ‘বুড়ি শয়তান ড্যাবরা না থ্যাবড়াকে’ আনা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, সরকার তারেক রহমানকে ভয় পায়। কারণ খালেদা জিয়ার পর তাঁদের নেতা তারেক। কিন্তু শেখ হাসিনার পর তাঁদের কেউ নেই।
সজীব ওয়াজেদ সম্পর্কে রেহানা আক্তার বলেন, তিনি একজন মাতাল, অস্ত্র রাখার কারণে পুলিশ ধরেছে। সজীব ওয়াজেদ যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করছেন কোটি কোটি টাকা। তিনি এত টাকা কোথায় পান। তাঁর বাবা তো ব্যবসায়ী ছিলেন না।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে রেহানা আক্তার বলেন, গান আছে ‘তুতু তুতু তারা, মর্জিনার মা মার্কা মারা’, আর এখন জনগণ বলছে ‘শেখ হাসিনার মুখ মার্কা মারা’। তিনি বলেন, ‘মইন-ফখরুদ্দীনের কোলে বসে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। শুধু কোলে নয়, আর কোথায় কোথায় বসেছেন কে জানে!’ তাঁর এই বক্তব্য পরে স্পিকার এক্সপাঞ্জ করেন।
স্পিকার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা স্থগিত করলে রেহানা আক্তারের বক্তব্য নিয়ে মাগরিবের আজানের পর পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনা হয়। এতে সংসদের চিফ হুইপ, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও জাসদের সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদল অংশ নেন।
মইন উদ্দীন খান বলেন, বিরোধী দলের সাংসদ যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা শালীনতার ন্যূনতম মাত্রা অতিক্রম করেছে। কথা বলার স্বাধীনতার নামে কেউ যদি এ রকম ভাষা প্রয়োগ করে, সংসদের পরিবেশ নষ্ট করে, তাহলে বাজে উদাহরণ সৃষ্টি ছাড়া কিছুই হবে না। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, একটু আগে রাষ্ট্রপতি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিচারপতিদের নিয়ে যে ভাষা ব্যবহার করা হলো, তা কী করা হবে। এ সময় তিনি বিরোধী দলের সাংসদ রেহানা আক্তারের কিছু অশালীন বক্তব্যের উদাহরণ তুলে ধরে কার্যপ্রণালি বিধি উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। তাঁর বক্তৃতার সময় বিরোধী দলের সদস্যরা চিৎকার করতে থাকেন। তখন সরকারি দল থেকে পাল্টা জবাব দেওয়া হয়। হইচইয়ের মধ্যেই মঈন উদ্দীন খান বলেন, সংসদ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে অশালীন ভাষা পরিহার করে সংসদে আসতে হবে।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন তাঁর বক্তব্যে মঈন উদ্দীন খানের উদ্দেশে বলেন, একজন নবীন সাংসদের কাছ থেকে নিয়ম শিখতে হবে না, কার্যপ্রণালি বিধি সম্পর্কে জ্ঞান নিতে হবে না। সরকারের শেষ বেলায় এসে এ রকম সুন্দর বক্তব্য দিলে মন্ত্রী হওয়া যাবে না। তিনি বলেন, অশালীন বক্তৃতা ডান দিক থেকে বন্ধ হলে বাম দিক থেকেও বন্ধ হবে। যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি ও সৌদি কূটনীতিকের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেন না, তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদের চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ বলেন, ‘সদস্যপদ রক্ষার জন্য তাঁরা সংসদে এসেছেন। এটা জনগণ বোঝে। ৯০ দিন পূরণের আট দিন বাকি থাকতে তাঁরা সংসদে এসেছেন। এখানে এসে ধান ভানতে শিবের গীত গাইছেন।’
এর পরে ৩০০ বিধিতে বক্তৃতা দেওয়ার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘প্রথমবার সংসদে এসে যা শুনলাম তাতে মানুষ রাজনীতিবিমুখ হবে। এ রকম ভাষা নিষিদ্ধপল্লিতেও ব্যবহার হয় না। অথচ এ রকম ভাষা ব্যবহারের সময় বিরোধীদলীয় নেত্রীকে টেবিল চাপড়াতে দেখেছি।’
রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় সরকারদলীয় সাংসদ ও হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামী আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এই দলটি স্বকীয়তা হারিয়েছে। নিজেদের ঐতিহ্য হারিয়েছে। বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে জামায়াতের নির্দেশে।
বিএনপিদলীয় সাংসদ শহিদউদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিরোধী দলের সব গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে সরকার বাধা দিচ্ছে। বিএনপির মহাসমাবেশ বানচাল করতে সব কূটকৌশল তারা নিয়েছে, কিন্তু পারেনি। তিনি দাবি করেন, বিএনপি আইএসআইয়ের কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়নি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট। দুররানি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে যে হলফনামা দিয়েছেন, সেখানে কোথাও বিএনপিকে টাকা দেওয়ার কথা বলেননি। এই সংবাদ কেবল আরব-আমিরাতের খালিজ টাইমস-এ ছাপা হয়েছে। পাকিস্তানের কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি। তিনি বলেন, পাঁচ কোটি রুপি কোনো রুপি হলো, যা পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নিতে হবে। এ সময় সরকারদলীয় সাংসদেরা ‘শেম’ ‘শেম’ বলে চিৎকার করতে থাকেন।

No comments

Powered by Blogger.