কালের পুরাণ-আস্থা, অনাস্থা ও রাস্তার রাজনীতি by সোহরাব হাসান

গণতন্ত্রের সর্বজনীন সংজ্ঞা হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য জনগণের শাসন। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র কখনোই ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও হবে কি না যথেষ্ট সংশয় আছে। যে দেশে ৪৭ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর, ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভোগে, সেই দেশে গণতন্ত্র বরাবরই মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী মানুষের জন্য। বৃহত্তর জনগণ তার সুবিধা কখনো পায় না।

বর্তমান বাংলাদেশ ও তার পূর্বসূরি পাকিস্তানের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই করেছে। ধন নয়, মান নয়, অর্থ নয়, বিত্ত নয়, কেবল গণতন্ত্রের একটি শর্ত পূরণ অর্থাৎ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারা ৬৩ বছর ধরে রাস্তায় আছে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের ১১ বছর এবং ইয়াহিয়া খানের দুই বছর গণতন্ত্রের জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি। তারপর ১৯৭০ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম সাধারণ নির্বাচনেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেই নির্বাচনী ফলকে নস্যাৎ করতে গিয়ে পাকিস্তানি শাসক চক্র এ দেশের মানুষের ওপর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, যার অনিবার্য পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার মূল কথা যে গণতন্ত্র, ৪০ বছর ধরে তা অধরাই থেকে গেল।
যে দলটি স্বাধীনতার সিপাহশালার বলে দাবি করে, সেই আওয়ামী লীগে আবার ডান-বামের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে সরে এসেছে বলে মায়াকান্না শুরু করেছেন। তাঁদের আক্ষেপ, আওয়ামী লীগ নাকি বামদের হাতে চলে গেছে। যে দলটিতে এখন ব্যবসায়ী ও কমিশনভোগীদের প্রাধান্য, সেই দলে বাম আসবে কোত্থেকে? প্রেমে ও ক্ষমতার বঞ্চনার জ্বালা মেনে নেওয়া কঠিন। ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সেই জ্বালায় পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের ভেতরের এই লঘু ঘূর্ণিঝড়ে অনেকেই শঙ্কাবোধ করছেন। অতীতেও আওয়ামী লীগকে বাইরে থেকে কেউ কাবু করতে পারেনি। সর্বনাশ করেছে ভেতরের লোকেরাই। আওয়ামী লীগে এখন নানামুখী তৎপরতা—মন্ত্রী বনাম নেতা, নেতা বনাম কর্মী, শহর বনাম মফস্বল, সুবিধাভোগী বনাম বঞ্চিতদের বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।
দলের এ অবস্থা দেখে একজন প্রবীণ সাংবাদিক ঘরোয়া আলাপে বললেন, ৬২ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে ভীষণ ঐক্যবদ্ধ থাকে। নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে থাকেন। জেল-জুলুমের পরোয়ানা করেন না। কিন্তু ক্ষমতায় গেলেই আওয়ামী লীগের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আরেক লেখক-ইতিহাসবিদ লিখেছেন, ‘....আওয়ামী লীগ বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে চায় না।’ কিছুদিন ক্ষমতায় থেকে, কিছু জনহিতকর কাজ করার পর আউল বাউল হয়ে যায় সবকিছু। খালি মনে হয় যথেষ্ট হলো। রাজপথে থাকাই ভালো। না হলে ১৯৭৫ বা ২০০১ এর আগের ঘটনাবলির সৃষ্টি হবে কেন আড়াই বছরের মাথায়।’ (যখন প্রধানমন্ত্রী থেকেও কেউ শক্তিশালী হয়ে ওঠে, মুনতাসীর মামুন, জনকণ্ঠ, ৫ জুন, ২০১১)।
এদের দুজনের কেউই আওয়ামী লীগের বিরোধী নন। বরং সুখ-দুঃখে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলেন, আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে প্রায় আড়াই বছর। বিগত বিএনপি সরকারের প্রথম আড়াই বছরের সঙ্গে তুলনা করলে একে পুরোপুরি ব্যর্থ বলা যাবে না। সমস্যা সমাধানে বিএনপি সরকার ছিল নিষ্ক্রিয়। আওয়ামী লীগের অন্তত চেষ্টা আছে । তবে কোনো ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয়তা জনমনে আশা না জাগিয়ে শঙ্কা তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা সংবিধান সংশোধনের কথা বলা যায়। এই মুহূর্তে এটি জাতির কোনো সমস্যা নয়। বিশেষ কমিটি অষ্টম সংশোধনী থেকে এক চিমটে নুন এবং পঞ্চম সংশোধনী থেকে এক চিমটে গুড় এবং বাহাত্তরের সংবিধান থেকে এক মগ পানি নিয়ে সেক্যুলার সংবিধানের ওরস্যালাইন বানিয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ রেখে আর যাই হোক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান হয় না। রাষ্ট্রও হয় না।
আড়াই বছরের মাথায় এসে দেশবাসী যে মহাসংকটের মুখোমুখি, সেটি অনেকটা আওয়ামী লীগেরই তৈরি। আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে আড়াই বছর পর। এখনই সেই নির্বাচন কার অধীনে হবে, কীভাবে হবে এবং সে সময়ে কারা ক্ষমতায় থাকবে, তা নিয়ে আগাম আওয়াজ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
বিএনপি বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে ১/১১ এনেছিল। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যটাও দেশবাসী জানতে চায়। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আওয়ামী লীগের মস্তিষ্কজাত সন্তান, সেই সন্তানকে মাত্র ১৬ বছরের মাথায় হত্যা করার চেষ্টা কেন? বলবেন, আদালতের রায়। আদালত কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি সরাসরি বাতিল করে দিয়েছেন? দেননি। আদালত একে সংবিধানবহির্ভূত বললেও আগামী দুটি নির্বাচন করার কথা বলেছেন। এই ব্যবস্থা থেকে বিচার বিভাগকে বাদ দিতে সংসদকে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে গঠিত হবে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারত। কিছুদিন আগেও সংসদীয় বিশেষ কমিটি জোর গলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলেছিল। এখন তারা সরাসরি বাতিলের সুপারিশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আদালতের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার সুযোগ নেই। আবার তিনি বলছেন, বিরোধী দলের কোনো প্রস্তাব থাকলে সংসদে এসে দিক। আগে জানা প্রয়োজন আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা কী করতে চান? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে এ ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করলে জনগণ অবশ্যই সন্দেহ করবে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি ১০০ দিন হরতাল করে থাকে, এখন বিএনপি-জামায়াত সেই ব্যবস্থা বহাল রাখতে আরও ১০০ দিন হরতাল করবে না, তার নিশ্চয়তা কী? এতে জনগণের জীবন থেকে ২০০ দিন হারিয়ে যাবে। দেশের সম্পদ নষ্ট হবে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মানুষের কষ্ট বাড়বে। তাতে কী? দুই পক্ষের জেদ তো বজায় থাকল। বিশেষ কমিটি বলেছে, তারা বিএনপিকে আলোচনায় ডেকেছিল, কিন্তু তারা আসেনি। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী ভাবা হয়। তারা দুই দফা সংসদ নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারল, কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে একবারও বসল না। তাঁকে বৈঠকে না ডেকে সাক্ষাৎকার চাইলে সেটি অনেক বেশি শোভন হতো। বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়তো সৌজন্যের খাতিরেও তাদের সাক্ষাৎ না দিয়ে পারতেন না। দ্বিতীয়ত, সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধী দলকে একটি সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়টি অঙ্কের হিসাবে ঠিক থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ঠিক ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, বিরোধী দলকে তিনি সংখ্যার অনুপাতে দেখবেন না। কিন্তু সরকারি দলের প্রতিটি আচরণে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, বিরোধী দল কয়টি আসন পেয়েছে।
গণতন্ত্রের মোদ্দাকথা যদি হয় আলাপ-আলোচনা, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, পরস্পরকে আস্থায় নেওয়া, দেশ ও জনগণের কল্যাণে একসঙ্গে কাজ করা—তাহলে বলব, সেই গণতন্ত্রের স্বাদ আমরা পাইনি। হ্যাঁ, নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর একবারই দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতিফলন দেখেছে, ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনী গ্রহণের সময়। সেই সংশোধনীর পর সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা, মন্ত্রী-এমপিরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মিষ্টিমুখ করেছিলেন। দীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসন শেষে সেই আনন্দে সবাই শরিক হয়েছিলেন। কিন্তু সেই মধুরেণ সমাপয়েৎ হতেও সময় লাগেনি। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে বিল পাস করার আগে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বিতর্ক হয়, আলোচনা হয়। আর আমাদের এখানে বিরোধী দল সংসদেই যায় না। ফলে বিনা বাধায়, আলোচনায় ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়। পরবর্তী সরকার এসে সেই ‘হ্যাঁ’কে ‘না’ করে দেয়।
গণতন্ত্রের আরেকটি পূর্বশর্ত হলো পারস্পরিক আস্থা। গণতন্ত্রে এক পক্ষ ক্ষমতায় যায়, আরেক পক্ষ বিরোধী দলে। কিন্তু দেশ পরিচালনায় তাদের মধ্যে ন্যূনতম কর্মসম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এক দল আরেক দলকে শত্রু বা বিদেশি চর ভাবলে গণতন্ত্র চলে না। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও জনগণের মৌলিক বিষয়ে মতৈক্য থাকা প্রয়োজন। সরকারি দলের জবরদস্তি এবং বিরোধী দলের অসহযোগিতা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। আগের কথা বাদ দিলেও নব্বই-পরবর্তী চারটি গণতান্ত্রিক শাসনামলে আমরা কী দেখে আসছি? ক্ষমতাসীনেরা সবকিছু দখল করতে চায়, বিরোধী দল সবকিছুতে ‘না’ বলে। এই ‘হ্যাঁ’য়ের অত্যাচার ও ‘না’ ব্যাধি না সরাতে পারলে আমাদের গণতন্ত্র বিপদমুক্ত হবে না।
গণতন্ত্রে জবরদস্তির কোনো জায়গা নেই। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অধৈর্য হননি। তিনি ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতায় গেছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে হরতাল ডাকেননি। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে পাঁচ বছরের মতো। এরই মধ্যে তারা অধৈর্য হয়ে গেছে। ক্ষমতায় থাকতে কী করেছে তারা, জনগণ ভুলে যায়নি। এর অর্থ এই নয় যে সরকার অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করবে না। অবশ্যই প্রতিবাদ করবে। কিন্তু কথায় কথায় সরকার পতন বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের আওয়াজ মানুষ পছন্দ করছে না। একটু ধৈর্য ধরুন। আমাদের দেশে সরকার মানে দেশ পরিচালনা বা সেবার দায়িত্ব নয়, পাঁচ বছরের জন্য দেশকে ইজারা নেওয়া। সেই ইজারা হাতছাড়া হয়েছে বলেই বিএনপি মরিয়া হয়ে উঠেছে।
শুক্রবার সকালে এই লেখাটি যখন লিখছি, তখনই খবর পেলাম, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দেশবাসীকে আরও ৩৬ ঘণ্টা হরতাল উপহার দিয়েছে। তার আগের দিন জাতীয় সংসদে বাজেট উপহার দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দেশের প্রধান বিরোধী দল কিছু না দিলে তাদের মান রক্ষা হয় না যে। এ জন্য ৩৬ ঘণ্টার হরতাল। রোববার সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয়ে সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। আবার আমরা হরতাল যুগে প্রবেশ করলাম। মানবসভ্যতা অগ্নি, প্রস্তর, লৌহ, কৃষি, শিল্প ইত্যাদি যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে, আর আমাদের নেতা-নেত্রীরা সেই হরতাল যুগেই পড়ে আছেন। পাঁচ বছর পর পর মহড়া দিচ্ছেন। একজনের জুতোয় আরেকজনের পা! কেউ কারও চেয়ে কম যান না। আপাতত আমরা এর থেকে মুক্তির পথ দেখছি না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.