ইতিউতি-অদ্ভুত বিচারের দেশ by আতাউস সামাদ

প্রবীণ সাংবাদিক নির্মল সেন গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে তাঁর একটি লেখার শিরোনাম দিয়েছিলেন 'স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই'। অধুনালুপ্ত সংবাদপত্র দৈনিক বাংলায় বিখ্যাত এই সাংবাদিকের ওই লেখা চারদিকে ঝড় তুলেছিল। শিরোনামটি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ঘুরছে মুখে মুখে।

নির্মল সেন তাঁর লেখায় প্রতিবাদ করেছিলেন সেই সময় চারদিকে যে গুপ্তহত্যা চলছিল এবং রক্ষী বাহিনী ও পুলিশের হাতে বহু বিরোধী মতাবলম্বী যেকোনো কারণ ছাড়াই নিহত হচ্ছিলেন তার বিরুদ্ধে। এসব বহু ঘটনায় নিহতদের লাশ বেওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া অনেকের মৃত্যু হয়েছে দুর্বৃত্ত সন্দেহে উত্তেজিত জনগণের হাতে গণপিটুনি খেয়ে। এ রকম দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিহতদের অনেকেই ছিলেন নিরীহ ও নিরপরাধ। নির্মল সেন তাঁর লেখায় এ সব কিছুরই অবসান চেয়েছিলেন।
যেকোনো পরিবারের যেকোনো সদস্য নিহত হলে সেই পরিবারটিতে স্থায়ীভাবে একটা জখম তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁরা বীরের মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের চরম আত্মত্যাগের দরুন বিশেষভাবে শ্রদ্ধাভাজন হয়েছেন। তাঁদের পরিবার-পরিজনকেও সবাই সম্মান ও সহানুভূতি দেখায়। এতে তাঁরা কিছু সান্ত্বনা পান, কিন্তু তবুও কোনো কিছুতেই তাঁর না থাকার অভাব দূর হয় না। মুক্তিযুদ্ধের পর চলি্লশ বছর পার হয়েছে, কিন্তু এখনো শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় অবধারিতভাবে বীর শহীদদের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে, আর সেই সঙ্গে থাকে একটি মন্তব্য, 'আমাদের ছেলেটা আজ থাকলে আমাদের পরিবারটা অন্য রকম হতো।' এ শূন্যতা দূর হয় না আবার, এ শূন্যতার ওজন অনেক ভারী। মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ হয়েছেন এমন দু-চারজনের পরিবারের সঙ্গেও পরিচয় আছে। এ রকমভাবে হারিয়ে যাওয়া এক কিশোরের মা-বাবাকে ছটফট করতে দেখেছি বহু বছর। অশান্ত বাবা বোধ হয় এখনো কোনোখানে ১০-১৫ মিনিটের বেশি স্থির হয়ে বসতে পারেন না।
আমরা স্বাধীন হওয়ার পর বছরখানেকের মধ্যে দেশে বেশ অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তখন অবৈধ অস্ত্রধারী, ডাকাত বা ছিনতাইকারী হিসেবে সন্দেহ করে রাস্তার লোকজন সন্দেহভাজনকে প্রচণ্ড পিটুনি দিয়েছে। তাতে মারাও গেছেন অনেক মানুষ। এমনভাবে নিহতদের মধ্যে যাঁরা একেবারে নির্দোষ, তাঁদের পরিবার-পরিজনের রয়েছে একই সঙ্গে বুকভরা বেদনা ও ক্ষোভের যাতনা। কারণ তাঁদের অভাগা স্বজনটি খুন হয়েছেন নির্মমভাবে। তাঁর কথিত অপরাধের কোনো বিচার হয়নি। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো সুযোগ পাননি। অথচ তাঁকে অন্যায়ভাবে খুন করা হলেও তাঁর নামের সঙ্গে যোগ হলো 'সন্দেহভাজন' হওয়ার কলঙ্কতিলক।
ইদানীং বাংলাদেশে আমরা এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষত র‌্যাব ও পুলিশের হাতে প্রতি মাসেই কিছু না কিছু লোক নিহত হচ্ছে। ওই হত্যাকাণ্ডের পর এসব বাহিনীর তরফ থেকে বলা হচ্ছে, নিহত ব্যক্তি সন্ত্রাসী ছিল এবং সে নিহত হয়েছে বন্দুকযুদ্ধে। এ নিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন অভিযোগ করেই চলেছে, এগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং এসব খুনের বিচার হতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দাবি করেছেন, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নেই। অথচ তাঁরই মন্ত্রণালয় থেকে শুধু র‌্যাবের হাতে রামপুরায় এক যুবক নিহত হওয়ার পর এবং র‌্যাব ও পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়ে জেলখানায় আরেক যুবক মারা যাওয়ার বিষয়ে কমিটি করে তদন্ত করা হয়। তদন্তের পর কমিটির সদস্যরা জানান যে দুটি ঘটনাই ঘটেছে র‌্যাব ও পুলিশের অতি উৎসাহে এবং তাঁরা সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন না করার ফলে। তাঁরা ওই দুই বাহিনীর অপরাধীদের আইনি শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে আদালতে মামলা করার সুপারিশ করেন। সরকার এখনো তাঁদের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়নি।
সম্প্রতি ঝালকাঠির এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমন এক র‌্যাব সদস্যের গুলিতে একটি পা হারালেও তার চিকিৎসা শুরু হতে না হতে র‌্যাব তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করেছে এবং তাকে দুর্বৃত্ত বলে চিত্রায়িত করেছে। দেশের সংবাদপত্রগুলো, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তার পাশে দাঁড়ালে সে হাইকোর্ট থেকে জামিন পায়, কিন্তু তার বিরুদ্ধে করা মামলা থেমে নেই। প্রকৃতপক্ষে র‌্যাব ও পুলিশের তৎপরতায় থানায় সন্ত্রাসীদের যে তালিকা আছে, তাতে তার নাম উঠে গেছে। বলা চলে, এ মুহূর্তে সে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের পথযাত্রী।
গত বুধবার বার্তা সংস্থা বিডিনিউজের প্রচারিত একটি খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে মিরপুরের রূপনগর এলাকার বাসিন্দা একটি পরিবারের ছেলে ইমতিয়াজ হোসেন আবীর গত ১১ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পুলিশ দাবি করেছে, আবীর ডাকাতদলের সদস্য ছিল এবং সে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। অথচ এর আগে আবীর সম্পর্কে সে যে ডাকাত এ রকম কোনো অভিযোগ পুলিশের কাছে ছিল না। আবীর নিহত হওয়ার পর পুলিশ একটি ডাকাতি মামলা করে, যাতে আবীরকে প্রধান আসামি দেখানো হয়েছে। অন্য আসামিদের কথা বলা হয়েছে তারা অজ্ঞাতপরিচয়। গত পরশু পর্যন্ত পুলিশ ওই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের কারো পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি। কাউকে গ্রেপ্তারও করেনি। এতে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ হয় যে মামলাটি বানোয়াট। এও সন্দেহ জাগে যে কোনো পুলিশ অন্য কোনো কারণে আবীরকে হত্যা করেছে এবং থানা তাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করেছে। আবীরের পরিবার এ ব্যাপারে কোনো মামলা করেনি এ জন্য যে তারা মনে করে, তাতে কোনো ফল হবে না। এদিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পরিবারটির সদস্যরা নিজেদের একটা খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছেন। তাঁরা কোনো সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন না, বলা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। তাঁরা নিশ্চুপ হয়ে রয়েছেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে ফরিয়াদ করছেন না। কিন্তু তাঁদের মনে তো ক্ষোভ ও ঘৃণার আগুন জ্বলছে। এ রকম যত মনে আগুন জ্বলছে, তা একসঙ্গে হলে আমাদের এ সমাজের কী অবস্থা হবে! ন্যায়বিচারের অভাব থাকায় হয় আমরা সর্বদাই একে অপরকে সন্দেহ ও ঘৃণা করব, আর প্রতিবাদ জেনে হয় প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজব, না হলে বিদ্রোহ ঘটার অপেক্ষায় থাকব।
সে রকম কিছু হলে কিন্তু অসুবিধায় পড়বেন রাজনীতিবিদরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সদস্যদের জনগণ চিনে রাখে না। সাধারণ মানুষ চেনে রাজনৈতিক নেতাদের, রাজনীতিবিদদের, কারণ তাঁরা যেচে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তাঁরা যদি ভালোভাবে সরকার চালাতে না পারেন, তাঁরা যদি অধস্তনদের নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে না পারেন, তাহলে মানুষের যত রাগ, যত ক্ষোভ_সবই হবে তাঁদের বিরুদ্ধে।
ইতিমধ্যে বর্তমান সরকার এক বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে। বিগত সরকারগুলোর সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক ফৌজদারি আইনে অভিযোগ করা হয়েছিল এই অজুহাতে ক্ষমতাসীন দলের লোকদের বিরুদ্ধে চলমান হাজার হাজার ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে তারা। মুক্তি দিচ্ছে খুনের মামলার আসামিদেরও। এ রকম একটি ঘটনায় পাবনার দুই সহোদরকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন নিহতদের পরিবার-পরিজন চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এবার তাঁদের কে জানি খুনিদের হাতে প্রাণ দেয়।
গত ১৩ মে বিভিন্ন পত্রিকায় একটি মর্মস্পর্শী আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল। ছবিটি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান ও বনপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি সানাউল্লা বাবুর বিধবা স্ত্রী ও কন্যা পরমার। সানাউল্লা বাবু ৮ অক্টোবর, ২০০৯ প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন রাজনৈতিক মিছিল করার সময়। তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায় এবং লাঠি দিয়ে পেটায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা। আলোচ্য ছবিটিতে দেখা যাচ্ছিল, কিশোরী পরমা এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ নিয়ে পাস করার খবর পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। সে পরীক্ষায় চমৎকার ফল করেও তার নিহত পিতার শোকে দুঃখের সাগরে ভাসছে। এর কয়েক দিন আগে খবর বেরিয়েছে যে সানাউল্লা বাবুকে হত্যার অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল তারা সবাই জামিন পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। এক দম্পতিকে তাদের নিজ বাসগৃহে গুলি করেছিল দুই বখাটে। তারাও জামিনে মুক্ত হয়েছে। এ রকম আরো আছে। আবার সরকার বিরোধীদের বেলায় আইনের প্রয়োগ অন্য রকম। সে ক্ষেত্রে প্রত্যাহার হওয়া মামলা নতুন করে চালু হয়। বানোয়াট মামলায় জামিন পেতে সুপ্রিম কোর্টে ছুটতে হয়। জামিন পেলে তা ধরে রাখতে মাসের পর মাস কাটে নিম্ন আদালতে হাজিরা দিয়ে। হতে পারে কোনো উদার বিচারক আইনের এমন ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন, যাতে ভয়ংকর অপরাধের আসামিরাও জামিন পেয়ে যেতে পারে। এসব দেখে মুখে এসেই যায়, 'অদ্ভুত বিচারের দেশ বাংলাদেশ।' কথাটা আজকাল জোরেশোরে মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.