২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা-তারেক বাবর হারিছ মুজাহিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন by আশরাফ-উল-আলম

২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

গতকাল রবিবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের এই নির্দেশ দেন। একই দিন এ ঘটনায় উদ্ভূত বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় তারেকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। গতকাল সকাল ১১টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত বিশেষ এজলাসে এ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে কারাগারে থাকা আসামিদের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
অভিযোগ গঠনের পর ট্রাইব্যুনাল আগামী ২৮ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন। ওই দিন থেকে এ মামলায় তারেক রহমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হবে।
হত্যা মামলা : গতকাল অভিযোগ গঠনের আদেশের দিন ধার্য ছিল। প্রথমে ২১ আগস্টের হামলার ঘটনায় উদ্ভূত হত্যা মামলায় আদেশ দেওয়া হয়। অন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় তাঁরা হলেন- জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ পরিবহনের মালিক হানিফ, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুল ইসলাম আরিফ, নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জেহাদ (হুজি) নেতা মাওলানা আবদুস সালাম, আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জি এম, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর আবু হোমাইরা ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা সাবি্বর আহমেদ ওরফে আবদুল হান্নান সাবি্বর, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই ও রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে বাবু ওরফে রাতুল বাবু, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, খোদা বক্স চৌধুরী ও শহুদুল হক, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি-দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, ডিসি পূর্ব পুলিশ সুপার ওবায়দুর রহমান খান, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন, এ মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ, এএসপি (অব.) মুন্সি আতিকুর রহমান এবং বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন।
তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ পরিবহনের মালিক হানিফ, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জেহাদ (হুজি) নেতা মাওলানা আবদুস সালাম, আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাবি্বর আহমেদ, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই রাতুল বাবুর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে হত্যার ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জনকে হত্যা, শেখ হাসিনাসহ অন্যদের হত্যার চেষ্টা, গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শতাধিক নেতা-কর্মীকে মারাত্মক জখম করার অভিযোগ আনা হয়। এসব অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রত্যেকে পরস্পর যোগসাজশে ষড়যন্ত্র করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার এবং মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিনকে অপরাধী আশ্রয় দেওয়া ও অপরাধীকে শাস্তি পাওয়া থেকে রক্ষার চেষ্টা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা খান হাসান সাঈদ ও ওবায়দুর রহমান খানের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আলামত নষ্ট করা, অপরাধীদের আশ্রয় দেওয়া ও অপরাধীকে শাস্তি পাওয়া থেকে রক্ষার চেষ্টা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ, এএসপি (অব.) মুন্সি আতিকুর রহমান, বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়া ও আরো দুজনকে দিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে ঘটনার মূল আসামিদের আড়াল করার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযুক্ত ৩০ আসামির মধ্যে বাবর, মুজাহিদসহ ১৮ জন কারাগারে আছেন। আসামি আরিফ জামিনে রয়েছেন। আদালত অভিযোগ পড়ে শোনালে প্রত্যেকে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। অন্যদিকে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কায়কোবাদসহ ১১ জন পলাতক রয়েছেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই অভিযোগ গঠন করা হয়।
বিস্ফোরক মামলা : হত্যা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার জন্য পরস্পর যোগসাজশে গ্রেনেড দখলে রাখা, বিস্ফোরণ ঘটানো, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা, সমাবেশে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের হতাহত করার অভিযোগে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, কায়কোবাদ, মুজাহিদ, হারিছ চৌধুরী, রেজ্জাকুল হায়দার, আবদুর রহিম ও হুজি নেতাসহ মোট ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বিচারক আদালতে উপস্থিত ব্যক্তিদের তা পড়ে শোনান। তাঁরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। ট্রাইব্যুনাল তারেকসহ পলাতকদের অনুপস্থিতিতেই অভিযোগ গঠনের নির্দেশ দেন।
বিস্ফোরক মামলার দায় থেকে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল হুদা, খোদা ব্ক্স চৌধুরী, শহুদুল হক, খান সাঈদ হাসান, ওবায়দুর রহমান খান, আবদুর রশিদ, মুন্সি আতিকুর রহমান, রুহুল আমিন, সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার ও এ টি এম আমিনকে অব্যাহতি দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছর দেওয়া হয় সম্পূরক অভিযোগপত্র : গত বছর ৩ জুলাই এই দুটি মামলায় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে তারেক রহমানসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এরপর দুটি মামলা বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার পর ২৩ জন আসামি মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন জানান। ২৪ কার্যদিবস ওই আবেদনের ওপর শুনানি হয়। গতকাল আদেশ দেওয়ার আগে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন নামঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের আদেশ : ট্রাইব্যুনাল আদেশে দুটি মামলায়ই বলেন, মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের জবানবন্দি, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, নথিভুক্ত আনুষঙ্গিক কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক উপাদান বিদ্যমান। এ কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। অন্যদিকে ১১ জনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মামলার উপাদান নেই বিধায় তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হলো।
ট্রাইব্যুনাল আদেশে আরো বলেন, দুটি মামলায় ২০০৮ সালের ৯ জুন হুজি নেতা মওলানা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। একই বছরের ৯ অক্টোবর ওই ২২ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। যেহেতু ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আগেই গঠন করা হয়, সেহেতু পুনরায় তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রয়োজন নেই।
উল্লেখ্য, প্রথমবার অভিযোগপত্র দেওয়ার পর ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে মামলা অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
অধিকতর তদন্তে ৩০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করায় দুটি মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট সরকারের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি মামলায়ই অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। গতকাল হত্যা মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার চলবে। অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলা থেকে ১১ জনকে অব্যাহতি দেওয়ায় ৪১ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার চলবে।
পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা : তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কায়কোবাদসহ পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে আগেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করার পর আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। চতুর্মুখী গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনা আহত হন। তবে গ্রেনেড সরাসরি শেখ হাসিনার শরীরে আঘাত না করায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনায় বর্তমান রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক নেতা-কর্মী।
এ ঘটনায় মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী পৃথক তিনটি এজাহার দায়ের করেন। একত্রে সেগুলোর তদন্ত হয়।
তারেকের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের আবেদন খারিজ : গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর তারেক রহমানের পক্ষে অ্যাডভোকেট আবদুর রেজাক খান এক দরখাস্ত দেন। দরখাস্তে নিজেকে তারেকের পারিবারিক খরচে আইনজীবী নিয়োগে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি চান। ওই দিনই এই আবেদনের ওপর শুনানি হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এ আবেদনের বিরোধিতা করে বলা হয়, তারেক রহমান যেহেতু পলাতক সেহেতু পারিবারিক খরচে আইনজীবী নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। এ আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। গতকাল ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেছেন, আসামি তারেক রহমানের আইনজীবী নিয়োগের দরখাস্ত গ্রহণ করার আইনগত সুযোগ নেই। এ কারণে দরখাস্ত নাকচ করা হলো।
উল্লেখ্য, পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রকে আইনজীবী নিয়োগ করার বিধান আইনে রয়েছে।
সাক্ষীদের হাজির হতে সমন : ট্রাইব্যুনাল এ মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন আগামী ২৮ মার্চ। ওই দিন সম্পূরক অভিযোগপত্রভুক্ত সব সাক্ষীকে হাজির হতে তাঁদের প্রতি সমন জারি করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
বাবর লাফিয়ে ওঠেন : মামলায় সব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর কাঠগড়ায় বসা লুৎফুজ্জামান বাবর লাফ দিয়ে ওঠেন। তিনি কিছু বলতে চান। বিচারক বলেন, এখন বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। সুযোগ আসবে, তখন বলবেন। এর পরও বাবর বলেন, 'আপনার ওপরও আদালত আছে। সেটি রব্বুল আল আমিনের আদালত। এই মিথ্যার বিচার তিনি করবেন।' এরপর আলী আহসান মুজাহিদ বলেন, 'মিথ্যাভাবে মামলায় জড়িয়ে আমার চরিত্র হনন করা হয়েছে। আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে চাই।' বিচারক বলেন, 'আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে পরে কথা বলবেন।'

No comments

Powered by Blogger.