অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক উন্নয়ন by ড. মো. দানেশ মিয়া

মায়ের ভাষায় কথা বলা প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার, সেই অধিকারের মর্যাদা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে জাতিসংঘের মাধ্যমে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণার মাধ্যমে। প্রতি বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে সেই দিবস, যা বাঙালির মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।

মায়ের ভাষার অধিকারের মূলভিত্তি তো এগুলোই- মায়ের ভাষায় আমরা সহজে ভাব বিনিময় করতে পারি; মানব সন্তানের জন্মগ্রহণের পর সহজে সামাজিকীকরণের কাজটি এর মাধ্যমেই হয়; জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা সহজে এর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। আর এর মাধ্যমেই একটি জাতি, একটি দেশ উন্নত হয়। যেকোনো একটি জাতির উন্নয়নের অধিকারকে বহুকাল আগেই আন্তর্জাতিক মহল মেনে নিয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়নের পেছনে যে সেই জাতির মাতৃভাষা একান্তভাবে কাজ করে, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আমাদের অনেক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাংলাদেশের তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সমগ্র পৃথিবীকে আমাদের একুশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এবং এর সামগ্রিক যৌক্তিকতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তারই ফলে আমরা এই স্বীকৃতি অর্জন করেছি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর সাধারণ সম্মেলনে ঘোষণার মাধ্যমে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ২০০টি দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালিত হয় অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে। এই দিবসের তাৎপর্য আজ শুধু ভাষার অধিকারেই সীমাবদ্ধ নেই, ছোট-বড় প্রত্যেকটি জাতির স্বকীয়তা রক্ষার অধিকারেও পর্যবসিত হয়েছে। সমগ্র পৃথিবীতে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ করার ডাকও এই দিবসের তাৎপর্যে স্থান করে নিয়েছে। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য অনেক আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে। অনেক সময় পার হয়েছে, আমরা বাংলাদেশের সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি কি অর্জন করতে পেরেছি? যদি অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলি, কী করতে পেরেছি আমরা? স্বাধীনতার ৪০ বছর পর সাক্ষরতার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা লোকদের সংখ্যা কিছুটা কমলেও মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নূ্যনতম যে গুণগত মান দরকার, তা অনেকাংশই অর্জিত হয়নি। এখনো বিদেশি সাহায্য ছাড়া আমরা বড় কোনো উন্নয়ন কাজে হাত দিতে পারি না। একুশের চেতনা ছিল মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং যার যৌক্তিকতার মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি ও উন্নয়ন। সেই মুক্তি ও উন্নয়নের জন্য আমাদের মায়ের ভাষার সর্বত্র ও সাবলীল ব্যবহারের স্বাধীনতা কি আমরা পেয়েছি? অন্যান্য অনেক কিছু করার পাশাপাশি ভাষা ব্যবহারের জায়গাটায় আমাদের অনেক কিছু করার ছিল- সেটা করতে পারিনি বলেই আমাদের মুক্তি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে নানাভাবে প্রমাণ করে দেখানো যেতে পারে।
ভাষা, শিক্ষা ও উন্নয়ন একটি অন্যটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভাষা তথ্য ও তত্ত্ব তথা জ্ঞানকে প্রবাহিত করে, পাশাপাশি এই চর্চাকে সাবলীল করে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, এই জ্ঞান সৃষ্টি ও তার প্রবাহ। শিক্ষাকর্মের এই ফলই নির্ধারণ করে একটি জাতির উন্নয়ন। সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা যে একটি জাতির উন্নয়নের জন্য কত জরুরি, আমরা তা একটু খেয়াল করলেই জাপান, কোরিয়া, চীনে দেখতে পাব। এদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চার প্রতিটি স্তরে নিজেদের ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছে অনেক আগে থেকেই। ইংরেজি জানি না বলে আমরা যে ধরনের লজ্জাবোধ করি, তারা তা করে না। বরং নিজেদের ভাষায় ওরা ওদের সব কাজকর্ম করতে পারছে বলে গর্ববোধ করে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই একই রকম চিত্র আমরা দেখি। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকায় তো ইংরেজিই তাদের নিজস্ব ভাষা। উলি্লখিত প্রতিটি দেশই উন্নত এবং এই উন্নয়নের পেছনে তাদের নিজস্ব ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষমতায় পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত আমেরিকা ও ইংল্যান্ড তাদের নিজস্ব ভাষা ইংরেজি দিয়ে সমগ্র বিশ্বে ভাষার আধিপত্য বিস্তার করেছে। আজকে ইংরেজি ছাড়া আন্তর্জাতিক যোগাযোগ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্য ও তত্ত্বও জানা সম্ভব নয়। এসব কারণে আমাদের ইংরেজি জানতেই হয়। পৃথিবীর উন্নত অইংরেজিভাষী দেশগুলো আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এবং তাদের নিজস্ব জ্ঞান-চর্চার মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক মান সমুন্নত রাখতে ইংরেজির সঙ্গে একটি সঠিক বিনিময়/দোভাষী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছে। এতে তাদের শিক্ষা ও উন্নয়ন পেছনে পড়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকছে না। কিন্তু আমরা এই কাজটি এখনো করতে পারিনি। না পেরেছি ইংরেজি ভালো করে শিখতে, না পেরেছি বাংলা ভাষায় সব কিছু করতে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের এই অবস্থান অনেক নাজুক বলেই আমার মনে হয়। চাপিয়ে দেওয়া একটি বিদেশি ভাষায় ছাত্ররা বেশির ভাগ বিষয়ে পড়াশোনা করে কখনো আংশিক, কখনোবা কোনো কিছু বোধের মধ্যে না এনেই সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে। প্রযুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা অন্যান্য বিজ্ঞানে যেসব বিষয় বিদেশি ভাষায় বিভিন্ন বই ও জার্নালের মাধ্যমে পড়ানোর চেষ্টা করা হয়, কিংবা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, সেসব যদি ইংরেজিতে না হয়ে বাংলায় হতো, তাহলে এই বিজ্ঞানচর্চা যে সত্যি সত্যি জ্ঞান সৃষ্টি করত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে আমাদের দেশেও অনেক বিজ্ঞানী তৈরি হতো বলে আমার বিশ্বাস। কারণ বাংলায় যত সহজে একটি বিষয় নিজের বোধের মধ্যে আনা সম্ভব, অন্য কোনো ভাষায় কোনো বাঙালির পক্ষে তা সম্ভব নয়। এই 'সম্ভবের' কাজটি না করে আমরা 'অসম্ভবের' কাজটিই বাংলাদেশের প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করে যাচ্ছি। বিদেশি সাহিত্য ও ভাষাবিজ্ঞান ছাড়া অন্য যে বিষয়গুলো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চর্চা করা হয়, তার উদ্দেশ্য কোনো ভাষা শেখানো নয়, ভাষার মাধ্যমে শেখানো। আর তা কেবল মাতৃভাষায়ই পর্যাপ্ত ও সঠিকভাবে সম্ভব। যেসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজিতে পড়া ও পড়ানো বাধ্যতামূলক, সেখানে ছাত্রদের মধ্যে কতটুকু সে বিষয়ে জ্ঞান সৃষ্টি হচ্ছে কিংবা জ্ঞানের প্রবাহ হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
আগেই বলেছি, বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানার কোনো বিকল্প নেই। এই কাজটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ভালো ইংরেজি শিক্ষক ও যথার্থ শিক্ষা পরিবেশের মাধ্যমে করতে হবে। প্রত্যেকটি ছাত্রের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার পূর্বমুহূর্তে যেন ইংরেজিতে কথা বলা, লিখতে পারা এবং শোনে বুঝতে পারার সত্যিকার দক্ষতা তৈরি হয়, সে চেষ্টাটি প্রায়োগিকভাবে করতে হবে। ইংরেজি তথা যেকোনো বিদেশি ভাষা শেখার উদ্দেশ্যটিও স্পষ্ট থাকতে হবে সবার কাছে। সর্বশেষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার জন্য ইংরেজিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক ও জার্নাল প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় পাঠযোগ্য ও সহজবোধ্য অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সেল গঠন করে এই কাজটি করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্ব-স্ব বিভাগের বিশেষ করে অধ্যাপকদের প্রতি এক বা দুই বছরে একটি করে বিদেশি ভাষার বই বাংলায় অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানীর মাধ্যমে। স্ব-স্ব বিভাগ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মানের জার্নালের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা করতে পারে একই রকমভাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই কাজটি বাধ্যতামূলক করলে অনেক ভালো ফল পাওয়া যাবে। কোনো বাংলাভাষী শিক্ষক যদি ইংরেজিতে ক্লাস নিয়ে ছাত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করতে পারেন, তাহলে এই ধারণাটি কি পোষণ করতে পারি না যে তাঁর সেই বিষয়ে পর্যাপ্ত বোধ-জ্ঞান তৈরি হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে এই বিষয়টিকে বাংলায় কেন অনুবাদ করা যাবে না?
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.