এই দিনে-অতীত সংরক্ষণে সচেতন হোন by মুহাম্মদ লুৎফুল হক

আজ ৯ জুন, আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস। প্রতিটি দেশেই সরকারি পর্যায়ে একটি জাতীয় আর্কাইভস থাকে, যার অধীনে একাধিক প্রাদেশিক, আঞ্চলিক বা শাখা আর্কাইভস থাকতে পারে। জাতীয় আর্কাইভসে দেশের সব সরকারি সংস্থা এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তির ঐতিহাসিক গুণসম্পন্ন রেকর্ড বা দলিলপত্র সংরক্ষণ করা হয়।

জাতীয় আর্কাইভসকে বলা হয় জাতির স্মৃতি। স্থানীয় অর্থাৎ শহর ও নগর পর্যায়ে পৌরসভা আর্কাইভস গঠন করা হয়। সেখানে মূলত শহরের ব্যক্তি, সংস্থা ও সংগঠন, বাসস্থান ও স্থাপনা, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, খাজনা ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রভৃতি বিষয়ের তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এর বাইরে বিষয়ভিত্তিক আর্কাইভসও গঠিত হয়, যেমন—ফিল্ম আর্কাইভস, ক্রীড়া আর্কাইভস ইত্যাদি। বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাও নিজেদের সংস্থাভিত্তিক আর্কাইভস গঠন করে থাকে, যেমন—বিশ্ববিদ্যালয় আর্কাইভস, টি আর্কাইভস ইত্যাদি। বেসরকারি পর্যায়েও আর্কাইভস গঠিত হতে পারে, যেমন—হেরিটেজ আর্কাইভস।
বাংলাদেশে আর্কাইভস ও দলিলপত্র সংরক্ষণে সরকারের প্রতিনিধিত্বশীল ও সর্বোচ্চ সংস্থা হচ্ছে ন্যাশনাল আর্কাইভস অব বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস, যা ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে জমা আছে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি দলিলপত্র। জাতীয় আর্কাইভসকে শক্তিশালী করা বা কার্যকর করার জন্য ১৯৮৩ সালে জারি হয় ‘ন্যাশনাল আর্কাইভস অর্ডন্যান্স’। এই অর্ডন্যান্সের বলে জাতীয় আর্কাইভস দেশ ও বিদেশ থেকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র সংগ্রহ করে এবং এর তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশ করে, বেসরকারি পর্যায়ের সব আর্কাইভসকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়, দলিলপত্রের ব্যবহার, বিন্যস্তকরণ, ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ, ধ্বংস, হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতিমালা, বিধিমালা, নির্দেশিকা প্রণয়ন করে; সর্বোপরি জনসাধারণের সচেতনতার জন্য নিয়মিতভাবে আর্কাইভস ও দলিলপত্রের প্রদর্শনী করে। উন্নত ও সভ্য দেশগুলোতে আর্কাইভসকে যথেষ্ট মর্যাদা ও গুরুত্ব দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আর্কাইভস একটি স্বাধীন ফেডারেল এজেন্সি এবং জাপানের জাতীয় আর্কাইভস একটি স্বশাসিত সংস্থা। বাংলাদেশে অধ্যাদেশ অনুযায়ী জাতীয় আর্কাইভস স্বতন্ত্র অধিদপ্তর হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি অধিদপ্তরের দুই শরিকের একটি শরিক মাত্র।
বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জনবল। আর্কাইভসে মোট জনবল ৩৪ জন। এর মধ্যে চারজন প্রথম, একজন দ্বিতীয় এবং ১৩ জন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা। ভারতের জাতীয় আর্কাইভসে ৬০ জন এবং পাকিস্তান জাতীয় আর্কাইভসে ৩০ জনের বেশি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা আছেন। মালয়েশিয়ার জাতীয় আর্কাইভসে শুধু বাঁধাই শাখাতেই ৪০ জন স্টাফ আছেন। প্রারম্ভিক চাকরি হিসেবে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে যোগদানে শিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তিরা উৎসাহিত হন না, উপরন্তু সাংগঠনিক কাঠামোয় বিভিন্ন পদে পদোন্নতির সুযোগও কম, তাই আর্কাইভসে যে ধরনের মেধা দরকার, তা নেই।
সংগৃহীত অনেক প্রাচীন দলিলপত্র আর্কাইভসের বিভিন্ন কক্ষে দীর্ঘদিন ধরে স্তূপ আকারে মজুদ আছে। এভাবে আর কিছুদিন থাকলে এগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। রক্ষিত দলিলপত্র দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ ও বিনষ্টকারী কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য যেসব আধুনিক পদ্ধতি প্রচলিত আছে, আর্কাইভসে তার অভাব আছে। এ কারণে অনেক প্রাচীন, ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র হুমকির সম্মুখীন এবং ধীর প্রক্রিয়ায় ধ্বংস হচ্ছে। দি ইংলিশম্যান পত্রিকার ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর কয়েক দশকের সংখ্যা আর্কাইভসের অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ, কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে এর অনেক সংখ্যাই এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আর্কাইভসে মজুদ দলিলপত্রের ক্যাটালগ দীর্ঘদিনেও হালনাগাদ ও পূর্ণাঙ্গ করা হয়নি। অনেক নতুন সংগ্রহের ক্যাটালগ এখনো তৈরি হয়নি।
জাতীয় আর্কাইভসে মূলত কাগজনির্ভর দলিলপত্রের মজুদ আছে কিন্তু ফটোগ্রাফিক, ম্যাগনেটিক, ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল তথ্য, অডিও-ভিডিও দলিলপত্র ইত্যাদির সংগ্রহ নেই। কিছুদিন আগে আর্কাইভসের কিছু প্রাচীন দলিলপত্র ডিজিটাইজ করা হয়েছে, যা তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। তবে তথ্যসন্ধানী ও গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত নয় বা তা ব্যবহার করার কোনো সুযোগও আর্কাইভসে নেই। জাতীয় আর্কাইভসে মজুদ কাগজে সৃষ্ট দলিলগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য মাইক্রোফিল্ম বা ডিজিটাইজ করার একটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে এবং এ খাতে বরাদ্দও পাওয়া গেছে। তবে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না থাকায় এখনো কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি।
বার্ষিক বাজেটে আর্কাইভস প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য অর্থ বরাদ্দ পেয়ে থাকে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আর্কাইভসের জন্য ব্যয় হয়েছে মাত্র তিন থেকে চার লাখ টাকা। এ অর্থ আর্কাইভসের কোনো প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়নি। তবে আনন্দের কথা, আর্কাইভস সরকার ও বিদেশি সংস্থা থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে, যা দ্বারা নির্মাণকাজ সম্পন্ন ও যন্ত্রপাতি কেনা হবে। এ ছাড়া আরও ১০-১৫ কোটি টাকা পাইপলাইনে আছে। এসব অর্থ দিয়ে আর্কাইভসের প্রায় সব মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে এবং অনেকাংশে যুগোপযোগী হয়ে উঠবে। তবে প্রশিক্ষিত, যোগ্য ও দরকারি জনবলের অভাব বা ঘাটতি শিগগির পূরণ না হলে ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না, বরং বরাদ্দ পাওয়া অর্থের অপচয়ই হবে।
নীতিনির্ধারকদের কাছে আবেদন থাকবে, ২৭ বছরের পুরোনো আর্কাইভস অধ্যাদেশ, যা অনেকভাবেই বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, তাকে হালনাগাদ করুন। জাতীয় আর্কাইভসকে স্বতন্ত্র মর্যাদা ও ক্ষমতা দিয়ে আরও শক্তিশালী করুন, যাতে জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নের সাহায্যার্থে এটি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক
lutful55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.