ভিন্নমত-প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা হতাশ, ক্ষুব্ধ by আবু আহমেদ

বাজেট ঘোষণার পরের কার্যদিবসে ঢাকার শেয়ারবাজার ৩১৩ পয়েন্ট পড়ে গেল। কারণ একটাই, বিনিয়োগকারীদের আশা বাজেট ২০১১-১২তে প্রতিফলিত হয়নি। বাজেট-পূর্ববর্তী এক সপ্তাহ বাজার ধীরে ধীরে বেড়ে একপর্যায়ে ছয় হাজার সূচকে পেঁৗছেছিল। বাড়ার মূল কারণ ছিল আসছে বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য একগুচ্ছ প্রণোদনা থাকবে।


কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে একগুচ্ছ প্রণোদনা তো দূরে থাকুক, নতুন করে কিছু বোঝা শেয়ারবাজারের ওপর চাপানো হয়েছে। সাধারণভাবে শেয়ারবাজারের জন্য আলাদা করে কোনো প্রণোদনা কেউ চাইতে পারে না। তবে এই বাজার যেহেতু পাবলিক ইন্টারেস্ট বা জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত, তাই বিশ্বের অনেক দেশেই এই বাজারকে কিছু বাড়তি ছাড় এবং প্রণোদনা দেওয়া হয়, বিশেষ করে ওই বাজার যদি উঠতি বাজার হয়।
বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর করপোরেট ট্যাঙ্ বা কম্পানির লাভের ওপর আয়কর কমানোর পক্ষে এ জন্যই আমরা গত দুই যুগ থেকে যুক্তি দিয়ে আসছিলাম। একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যখন শেয়ার ছেড়ে স্টক এঙ্চেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়, তখন সেই কম্পানির মালিক শুধু উদ্যোক্তাদের পরিবারের লোকজন থাকে না, তখন ওই ব্যবসার মালিক হাজারো সাধারণ লোক হয়ে পড়ে। এতে করে ওই ব্যবসার জবাবদিহিতা বাড়ে এবং সমাজে আয় বণ্টনের একটা ভালো সংস্কৃতিরও উদ্ভব হয়। আর ব্যবসার ক্ষেত্রেও প্রণোদনা দিতে হলে এসব ক্ষেত্রেই দেওয়া উত্তম মনে করি। একসময় বাংলাদেশে ব্যাংকিং কম্পানিগুলো অন্যান্য তালিকাভুক্ত কম্পানির সমান করপোরেট আয়কর দিত। বিগত কয়েক বছর তাদের বেশি করে, যা বর্তমানে ৪২.৫ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে। অথচ ব্যাংকগুলোর বিরাট আকারের ইক্যুইটি ক্যাপিটালের অর্ধেকের বেশি এখন সাধারণ জনগণের হাতে।
২০০৯-১০-এ ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে ভালো মুনাফা করেছে এবং আয় অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ভালো ডিভিডেন্ডও ঘোষণা করেছে। কিন্তু সত্য হলো, মন্দা আক্রান্ত শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর শেয়ার-মূল্য বেশি পড়ে গেছে। কারণ একটাই, সামনের বছর সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা হতাশা দানা বেঁধেছে। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত বাজেট যা করতে পারত তা হলো ব্যাংকিং কম্পানিগুলোর আয়ের ওপর ২.৫ থেকে ৫ শতাংশ ট্যাঙ্ কমিয়ে দিতে পারত। কিন্তু তা হলো না। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশ ফান্ড গঠন করা হলো। এই ফান্ড চেয়েছিল যারা এই ফান্ডের বা অংশ কিনবে তাদের আয়ের উৎস বা টাকা সাদা কী কালো তা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। কিন্তু বাজেট এ ক্ষেত্রেও নিশ্চুপ। অথচ সরকারকে ধার দিলে তথা ব্যক্তি যদি সরকারি বন্ড খরিদ করে, তাহলে ১০ শতাংশ ট্যাঙ্ দিয়ে কালো টাকাকে সাদা করতে পারবে। এটা কোন ধরনের নৈতিকতা? আর এতে কি অর্থনীতি বেশি উপকৃত হবে?
পাবলিক ইন্টারেস্ট বা জনস্বার্থ বেশি জড়িত ছিল বাংলাদেশ ফান্ডের ক্ষেত্রে। সে ফান্ড কোনো রাজস্ব প্রণোদনা পেল না, পেল সরকারি বন্ড আর এখানেই আমাদের হতাশা। শেয়ারবাজারের ওপর অনেক সুনামি বয়ে গেছে। প্রায় ৯ হাজার সূচক থেকে এটা পড়ে পাঁচ হাজার ৫০০তে বা তারও নিচে এসে ঠেকেছে। সরকারের এবং রেগুলেটরের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ৩৪ লাখ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিনিয়োগকারী এই বাজারে এসে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে বিনিয়োগকারী হলো। শেয়ারবাজার দু-তিন বছরের মধ্যে অনেকটা অখ্যাত অবস্থা থেকে চোখে পড়ার মতো শিল্পে পরিণত হলো। কিন্তু এদের স্বার্থকে রেগুলেটর তথা সরকার রক্ষা করতে পারেনি। এরা বিক্ষোভ করল, পুলিশ প্রতিরোধ করল। এদের বলা হলো হাঙ্গামার লোক এবং ফটকাবাজ। কিন্তু এদের কি দোষ ছিল? এদের বাজারে আনা হলো, কিন্তু এদের হাতে ১০ টাকার শেয়ারকে ৩০ গুণ বেশি মূল্যে তুলে দেওয়া হলো। সেটাও ঘটল রেগুলেটরের অনুমতি নিয়ে।
এক শ্রেণীর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে গেল, সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর বলা হলো, এ কী হলো, কে এমন করল, চোরকে ঠিকই ধরব ইত্যাদি। ততক্ষণে লিমন, আমেনা, আবদুল্লাহদের ১০ লাখ টাকার পুঁজি অর্ধেক ঝরে গেছে। এরা শেষ পর্যন্তও বুকে আশা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। এরা ভেবেছিল, বাজেটে তাদের জন্য কিছু না কিছু থাকবে। কিন্তু বাজেট ঘোষণার পর তারা শুধু হতাশই হলো। আর এখন নিয়তিকে মেনে নেওয়ার জন্য নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে। সরকারের মধ্যে একটা মহল আছে, যারা শেয়ারবাজারটাকেই অতটা গুরুত্ব দিতে চায় না। এটা হচ্ছে তাদের পুরনো চিন্তাপ্রসূত। যে অর্থনীতিতে শেয়ারবাজার সচল থাকে না, সে অর্থনীতি অন্তত আজকের দিনে উচ্চ প্রবৃদ্ধির আশা করতে পারে না। সরকার সব কাজকর্ম বন্ধ করে রাখলেও আমাদের লোকদের পরিশ্রমের ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে অবশ্যই নতুন আয় যোগ হবে। তাহলে সরকারের কাজটা কী? অন্যতম বড় কাজ হলো আর্থিক বাজারগুলোকে সচল রাখা। আর সে জন্যই শেয়ারবাজারে অব্যাহত পলিসি সমর্থনের প্রয়োজন আছে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.