কালান্তরের কড়চা-ড. জেকিল কখন এবং কিভাবে মি. হাইড হলেন! by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

দুই. পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা চক্র আইএসআই সম্পর্কে সে দেশের এক খ্যাতনামা কলামিস্টই মন্তব্য করেছেন, 'ওঝও রং ধহ রষষবমধষ পযরষফ ড়ভ অসবৎরপধহ ঈওঅ.' (আইএসআই মার্কিন সিআইএ-র একটি জারজ সন্তান)। কলামিস্টের মতে, এই জারজ সন্তান পাকিস্তানের সব দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ।


বর্তমানে জন্মদাতার সঙ্গে অবৈধ সন্তানের স্বার্থ-সংঘাত বেধেছে। লাদেনপন্থী ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে আমেরিকার তথাকথিত ওয়ার অন টেরোরিজমে আইএসআইয়ের দ্বিমুখী ভূমিকা। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানের সহায়তার জন্য আমেরিকা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার তার হাতে তুলে দিচ্ছে। আইএসআই অর্থলোভে প্রকাশ্যে আমেরিকাকে সমর্থন দিচ্ছে। তলে তলে সাহায্য জোগাচ্ছে আল-কায়েদাকে। বিন লাদেন হত্যার সময় আইএসআইয়ের এই ভূমিকা আমেরিকার চোখে ধরা পড়েছে।
লন্ডনে কর্মরত এক মার্কিন সাংবাদিক আমাকে বলেছেন, সিআইএর অবৈধ সন্তান আইএসআইয়ের হাতে আবার বাংলাদেশেও একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রকৃত জন্ম ও বিকাশ। গোটা সামরিক শাসনামলে (জিয়া ও এরশাদের আমল) এবং বিএনপি ও জামায়াতের শাসনামলে এর কর্মকর্তাদের বড় অংশের প্রকৃত আনুগত্য ছিল আইএসআইয়ের প্রতি। আইএসআই এই কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং বিএনপিকে ক্ষমতায় রাখা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন-পরাজয়ের নীল নকশাগুলো তারাই অঙ্কন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশের শিক্ষিত পেশাদার শ্রেণী (শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক প্রমুখ) ও বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশকে প্রচুর অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা বিলিয়ে ক্রয় করে ফেলার পরিকল্পনাটিও সেই গোয়েন্দা সংস্থাটির হাতে তুলে দিয়েছিল আইএসআইই।
আমার মার্কিন সাংবাদিক বন্ধুর এই খবর কতটা সঠিক, তা আমি জানি না। তবে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলে_এমনকি বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালেও এই গোয়েন্দা সংস্থার প্রবল প্রতাপ এবং ইনভিজিবল গভর্মেন্টের ভূমিকা গ্রহণ দেখে মার্কিন সাংবাদিকের মন্তব্যকে অসত্য মনে করা কঠিন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসে ডেপুটি হাইকমিশনার পদে নিযুক্ত ইরফান রাজার কার্যকলাপেই ধরা পড়ে যায় বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার পাকিস্তানমনা ঊর্ধ্বতন অফিসার এবং বিএনপি ও জামায়াতের এক শ্রেণীর নেতানেত্রীর সহায়তায় বাংলাদেশে মৌলবাদী সন্ত্রাস সৃষ্টি ও অভ্যুত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি। পবিত্র রোজার মাসেও এদের গোপন চক্রান্তের বৈঠক চলত ইফতার পার্টি অনুষ্ঠানের নামে।
শেষপর্যন্ত ইরফান রাজা ধরা পড়েন এবং হাসিনা সরকার তাঁকে বাংলাদেশে পার্সন নন-গ্রাটা (অবাঞ্ছিত ব্যক্তি) ঘোষণা করে তাঁর দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের শক্তিশালী আখড়া তখন পর্যন্ত ভাঙতে পারেনি। ইরফান রাজা পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে প্রভাবশালী 'ফ্রাইডে' কাগজের রিপোর্টারের কাছে গর্ব প্রকাশ করে বলেন, 'হাসিনা সরকার আমাকে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করতে পেরেছে; কিন্তু আমাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ভাঙতে পারেনি। তার প্রমাণ তারা পাবে বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনের সময়। আমরা একসময়ের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের শিবিরেও পেনিট্রেট করতে সক্ষম হয়েছি।'
আমার হাতের কাছে 'ফ্রাইডে' কাগজের পুরনো সংখ্যাটি নেই। তখনকার ডায়েরিতে টুকে রাখা তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরতে পেরেছি মাত্র। তাঁর পুরো বক্তব্য তুলে ধরতে পারলে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী, সম্পাদক ও কলামিস্টদের একটা উজ্জ্বল অংশকে ক্রমান্বয়ে ক্রয় করার একটা আভাস-চিত্র পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে পারতাম। আমার বন্ধু শফিক রেহমান তো প্রথম যৌবনে বামপন্থী কোনো বুদ্ধিজীবী কিংবা সম্পাদকও ছিলেন না। ছিলেন একজন প্রোগ্রেসিভ প্লেবয়। বামপন্থার দিকে তাঁর আকর্ষণ ছিল। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের দিকেই ছিল তাঁর ঝোঁক। তাঁকে বিভ্রান্ত বা প্রলোভনের দ্বারা বশ করা এমন কিছু কঠিন কাজ হয়তো ছিল না। কিন্তু কট্টর বামপন্থী, একদা বামপন্থী কাগজের সম্পাদক রূপে পরিচিত ও বিখ্যাত হওয়ার পর যাঁরা নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে ইরফান রাজা অথবা কথিত গোয়েন্দা সংস্থার রিক্রুটদের দলে গিয়ে ভিড়েছে, তাদের ভূমিকা আমার কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক ব্যাপার বলে মনে হয়েছে।
শফিক রেহমানের ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুস্থানীয় কারো কারো ধারণা, শফিক রেহমান যতদিন লন্ডনে একজন অখ্যাত বাঙালি প্রবাসী ছিলেন, ততদিন তাঁর দিকে ওই গোয়েন্দা সংস্থাটির নজর পড়েনি। কৈশোরে শফিক রেহমানের একমাত্র পরিচয় ছিল 'অধ্যক্ষ সাইয়েদুর রহমানের পুত্র'। বিবাহিত জীবনে তাঁর চেয়ে বিখ্যাত ছিলেন স্ত্রী তালেয়া রহমান। বিলেতের বাঙালি মহলে তাঁর পরিচয় ছিল 'তালেয়া রহমানের স্বামী'। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে পেশায় তিনি সাফল্য বা খ্যাতি কোনোটাই লাভ করেননি। ফলে সোস্যাল স্টেটাস রক্ষার জন্য দেশের 'সচিত্র সন্ধানী' নামক কাগজে লেখালেখি এবং জীবিকার জন্য বিদেশি বেতারে হাফ-চাকরির ওপর তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছে। তা ছাড়া স্ত্রীর উচ্চ আয় এবং বাবার টাকা-পয়সা, সম্পত্তির উত্তরাধিকার তো ছিলেনই।
তেমন অর্থাভাব শফিক রেহমানের ছিল না। কিন্তু তাঁর খ্যাতিমান বন্ধুদের তুলনায় তিনি খ্যাতিহীন, এই ক্ষোভটা সম্ভবত তাঁর মনে সবসময় ছিল। ফলে বিলেতের দীর্ঘ প্রবাসজীবন সঙ্গে করে তিনি দেশে ফিরে গিয়ে তাঁর কলাম 'যায়যায়দিন' নামটি গ্রহণ করে একটি সাপ্তাহিক ভিউজ ম্যাগাজিন বের করার উদ্যোগ নেন। অত্যন্ত সাদামাটাভাবে 'যায়যায়দিন' বের হয়। রাজনৈতিক মতামতের দিক থেকে চরমভাবে এরশাদ ও তাঁর সামরিক শাসনের বিরোধী। কিন্তু তাঁর স্বনামে-বেনামে লেখা রচনাগুলো স্যাটায়ার ও পর্ণোধর্মী। অল্পদিনেই পাঠকদের মধ্যে 'যায়যায়দিন' বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং এরশাদের সরাসরি বিরোধিতার জন্য প্রগতিশীল রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলেও সাহসী ও জনপ্রিয় সম্পাদক হিসেবে স্বীকৃতি পান শফিক রেহমান।
অনেকেরই ধারণা, শফিক রেহমান খ্যাতির তুঙ্গে ওঠার পরই ওই গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন কর্তাব্যক্তিদের নজরে পড়েন এবং জেনারেল এরশাদ তাঁর বিরুদ্ধে দমননীতি গ্রহণ করে তাঁকে আরো পরিচিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন। কথিত গোয়েন্দা সংস্থার কর্তারা তাঁদের গোপন তদন্ত রিপোর্টে এই জনপ্রিয় সম্পাদকের কোনো নীতিনিষ্ঠা নেই জেনেই সম্ভবত তাঁকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। কেউ কেউ বলেন, এই থিওরি সঠিক নয়। তাঁদের মতে, জে. এরশাদের রোষানলে পড়ে 'যায়যায়দিন' যখন বন্ধ হয়ে যায় এবং শফিক রেহমান দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে লন্ডনে এসে হতাশ জীবনযাপন করছিলেন এবং স্পেকট্রাম নামে একটি বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় রেডিও স্টেশন খুলে পার্টনারদের সঙ্গে ঝগড়ায় রেডিও থেকে বিতাড়িত হয়ে লন্ডনে একটি তন্দুরি রেস্টুরেন্ট খোলার চিন্তা-ভাবনা করছিলেন, তখন ওই গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাদের নজরে পড়েন।
এই থিওরির কোনটি সঠিক এবং কোনটি সঠিক নয়, অথবা দুটি থিওরিই শুধু গুজবভিত্তিক কি না তা আমি হলফ করে বলতে পারব না। তবে তখনকার পরিস্থিতি এবং শফিক রেহমানের হাবভাব, মতিগতি দেখে আমার মনে ধারণা জন্মেছিল, হয়তো দ্বিতীয় থিওরিটিই সত্য অথবা সত্যের কাছাকাছি। আমার গত সপ্তাহের লেখায় এ সম্পর্কিত একটি ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে আমাকে থামতে হয়েছে। কারণ 'কালের কণ্ঠে' আমার কলামের জন্য বরাদ্দ স্থান তখন শেষ। আমাকে লেখা অসমাপ্ত রাখতে হয়েছে। আজ সে ঘটনাটাই উল্লেখ করি।
তখন এরশাদ-হটাও আন্দোলন শুরু হতে যাচ্ছে। হঠাৎ লন্ডনের 'সানডে অবজারভার' কাগজে এরশাদ-মরিয়ম কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস হলো। রিপোর্ট করেছেন অবজারভার প্রতিবেদক লেসলি পামার। অবজারভারে পৃষ্ঠাজুড়ে সচিত্র বিবরণ ছাপা হয়েছে। কিছুদিন পর এই খবর আরো রসালোভাবে ছাপা হয়েছে ভারতের 'ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়াতে'। দুটি কাগজই এরশাদ সরকার বাংলাদেশে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এমন রসালো খবর দেশ-বিদেশে প্রচারিত হতে দেরি হয়নি। বিদেশি মিডিয়াকে ম্যানেজ করার জন্য জেনারেল এরশাদ লন্ডনে পাঠালেন তখন তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত মন্ত্রী (তখন কি তিনি উপরাষ্ট্রপতি?) ব্যারিস্টার মওদুদকে। তিনি অনেকের কাছে বলে বেড়ালেন তিনি অবজারভারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে এসেছেন। পরে এ সম্পর্কে তাঁর সব তর্জন-গর্জন কর্পূরের মতো উবে গেছে।
এই সময় ঢাকা থেকে আসা একটি গুজব লন্ডনের বাতাসেও ছড়িয়ে গেল। বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তারা জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। জেনারেলের নৈতিক স্খলন, অত্যধিক নারীপ্রীতি, ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ সামরিক শাসনের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে এবং জেনারেল এরশাদ এখন সামরিক বাহিনীর জন্য লায়াবিলিটি। ফলে তাঁরা চান ক্ষমতা থেকে তাঁকে অপসারণ করে অন্য কাউকে ক্ষমতায় আনতে। তবে আওয়ামী লীগকে নয়। আর্মিতে এমনিতেই জিয়া ভক্তদের একটা শক্ত অবস্থান ছিল। তারা এবার সক্রিয় হলো। ওই গোয়েন্দা সংস্থার অধিকাংশ প্রধান কর্তা তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। শুরু হলো জে. এরশাদকে সম্পূর্ণ ডিসক্রেডিট করার গোপন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। আমার সন্দেহ, সঠিক কি না জানি না, এই সময়েই কথিত গোয়েন্দা সংস্থার জিয়াপন্থী অংশ শফিক রেহমানকে তাদের দলে রিক্রুট করে।
আগেই বলেছি, আমার এই সন্দেহ পোষণের কারণ একটি ঘটনা। আমি তখন লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক 'নতুন দিনের' সম্পাদক। এরশাদ-মরিয়ম কেলেঙ্কারির খবরটি ইংরেজি কাগজ থেকে অনুবাদ করে ছবিসহ যাতে প্রকাশ করি, সে জন্য চারদিক থেকে পাঠকদের কাছ থেকে চাপ আসছিল। আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। দেশের রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে নারী কেলেঙ্কারির খবর আমাদের বাংলা কাগজে ছাপা ঠিক হবে কি না তা নিয়ে মনস্থির করতে তখনো পারিনি।
এই সময় শফিক রেহমান একদিন হন্তদন্ত হয়ে 'নতুন দিন' অফিসে এসে হাজির। তাঁর হাতে 'ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া' কাগজের একটি সংখ্যা। শফিক রেহমান তখনো আমার ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং নতুন দিন সম্পাদনায় আমাকে সাহায্য করেন। সেদিন আমার কক্ষে ঢুকেই কাগজটা আমার চোখের সামনে মেলে ধরে বললেন, 'দেখ, এরশাদ-মরিয়মের খবর এরা কিভাবে ছেপেছে! তোমার এখন আর ভাবনা-চিন্তা করা চলবে না। এ সপ্তাহের নতুন দিনেই খবরটা ছাপতে হবে।'
খবরটার উপর চোখ বোলালাম। কাগজটির একেবারে মধ্যভাগে সেন্ট্রাল ফোলডিংয়ের দুই পাশের পাতাজুড়ে খবর। সচিত্র এবং রঙিন। জেনারেল এরশাদ ও তাঁর প্রেমিকা মেরি অথবা মরিয়মের পাশাপাশি ঘনিষ্ঠভাবে বসা ছবি। নিউজও বেশ বড়। বললাম, 'শফিক, আমাদের কাগজ বের হয় শুক্রবার, আর বুধবার। কালই কাগজের আর্ট ওয়ার্ক শেষ করে প্রেসে পাঠাতে হবে। এই অল্প সময়ে ইংরেজি কাগজ থেকে খবরটা অনুবাদ ও টাইপ সেটের কাজ শেষ করে ধরানো সম্ভব হবে কি?'
শফিক রেহমান বললেন, 'ধরাতেই হবে।'
বলেছি, 'তুমি তাহলে চটপট অনুবাদ করে দাও।'
শফিক বললেন, 'আমার হাতে কয়েকটা কাজ এমনই জরুরি যে আমার পক্ষে অনুবাদে বসা সম্ভব হবে না। তুমিই তাড়াতাড়ি অনুবাদটি সেরে নাও।'
বলেছি, 'চেষ্টা করব, কাজটা করতে পারব কথা দিতে পারছি না।'
শফিক সে কথায় কান দিলেন না। বললেন, 'হ্যাঁ, আরেকটা কথা, কাগজের হাজারখানেক কপি বেশি ছেপো। অফিসের কাউকে বলো, শুক্রবার সকালেই যেন প্যাক করে রাখে। দুজন ভদ্রলোক আসবেন। তাঁরা কাগজ নিয়ে যাবেন। এক হাজার কাগজের দামও তাঁরা দিয়ে দেবেন।'
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কারা এই ভদ্রলোক?'
শফিক একটু গর্বিতভাবে হেসে বললেন, 'এরশাদকে যাঁরা হটাতে চান এবং হটাতে পারবেনও তাঁরা।'
আমি আর কথা বাড়াইনি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্য জরুরি কাজ হাতে এসে পড়ায় ইলাস্ট্রেটেড উইকলির খবরটা আর সময়মতো অনুবাদ করতে পারিনি। ভেবেছি, এরশাদ-হটাও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কোনো দল এই অর্ডারটা দিয়েছে। লন্ডনের অবজারভার, ভারতের ইলেস্ট্রেটেড উইকলির এই খবরযুক্ত সংখ্যা দুটি বাংলাদেশে ঢোকা নিষিদ্ধ। তাই 'নতুন দিনে' খবরটা ছেপে তারা দেশে ঢোকাতে চায়। তাতে আর তাড়াহুড়ার কি আছে? এমনিতেই খবরটা বাসি হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে ছাপলেই চলবে। দুই ভদ্রলোক কাগজ নিতে এলে বলে দেব আগামী শুক্রবার এসে নিয়ে যাবেন।
কিন্তু ব্যাপারটা যে এত সিরিয়াস, তা তখন বুঝতে পারিনি। ওই শুক্রবার বেলা ১০টার দিকে দুই ভদ্রলোক এসে হাজির। যুব বয়সী। চালচলন কথাবার্তায় মনে হয় আর্মির লোক। কিন্তু পরনে সিভিল ড্রেস। কাগজর প্যাক সেদিন পাওয়া যাবে না জেনে তাঁরা আঁতকে উঠলেন। বললেন, 'সর্বনাশ, তাহলে আমাদের সব প্ল্যান-পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যাবে। আমরা আজ বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকায় যাচ্ছি। কাগজগুলো আমাদের সঙ্গে যাবে। আজই ক্যান্টনমেন্টে বিলি হয়ে যাওয়ার কথা। এক সপ্তাহ পরে বিলি করলে তো কাজ হবে না। এরশাদ ইতিমধ্যেই সতর্ক হয়ে গেছেন। আগামী সপ্তাহে কাগজ বিলি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।'
সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনারা কারা?'
তাঁরা চুপ করে গেলেন। হয়তো বুঝতে পেরেছেন উত্তেজনার বশে তাঁরা একটু বেশি কথা বলে ফেলেছেন। যেমন হঠাৎ এসেছিলেন, তেমনি হঠাৎ চলে গেলেন।
শফিক রেহমান রাগ করে সে সপ্তাহে আর 'নতুন দিন' অফিসে এলেন না। আমি তাঁর রাগ ভাঙানোর জন্য পরের সপ্তাহেই ইলেস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া ও অবজারভারের নিউজ দুটো নিজে অনুবাদ করে ফলাও করে 'নতুন দিনে' ছেপেছি। কিন্তু শফিকের রাগ ভাঙল না, আর এলেন না নতুন দিন অফিসে। অবশ্যই সেই মিলিটারি চেহারার দুই ভদ্রলোকও এলেন না আর কাগজর প্যাকেট নিতে।
সৈয়দ শামসুর রহমান ফারুক (এখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) তখন নতুন দিনের সম্পাদকীয় বিভাগের সদস্য। শফিক রেহমানের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দুই দিন পর তিনি আমাকে বললেন, 'শফিকভাই আর আমাদের অফিসে আসবেন না। আমাকে বলেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বলেছেন, গাফ্ফারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বার এখানেই ইতি। সে শুধু আমার নয়, দেশেরও মহা ক্ষতি করেছে। এরশাদকে হটানোর একটা চমৎকার প্ল্যান সে নষ্ট করে দিয়েছে।'
ফারুককে জিজ্ঞেস করেছি, 'সে প্ল্যানটা কি ছিল, শফিক তা কি আপনাকে বলেছেন?'
ফারুক মাথা নেড়ে বলেছেন, 'না, আমাকে প্ল্যানের কথা কিছু বলেননি।'

লন্ডন, ২০ জুন, সোমবার, ২০১১
শেষাংশ আগামী মঙ্গলবার

No comments

Powered by Blogger.