নিত্যজাতম্‌-লজ্জা কিনতে রাজি নই by মহসীন হাবিব

সম্প্রতি অভিনব উপায়ে ভারতের একটি গ্রামের নাম পাল্টে গেছে। কোনো সরকারি দপ্তর গ্রামটির নাম পাল্টায়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো নামকে ধরে রাখার অভিসন্ধি নয়। কোনো সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাও (কৃষ্ণনগরের নাম রসুলপুর আর রাসুলপুরের নাম কৃষ্ণনগর হওয়ার মতো) এর সঙ্গে যুক্ত নেই।
নামটি পাল্টে গেছে ছোট একটি গ্রামকে সেবা দেওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে। পাল্টে যাওয়া নামটিও অদ্ভুত। শিবনগর নামের ছোট্ট গ্রামটির নাম হয়েছে এখন স্নেইপডিল ডটকম।
স্নেইপডিল ডটকম নামের একটি অনলাইন কুপোনিং কম্পানির মালিকের নাম কুনাল বাহল। আসলে তাঁর নামের শেষ অংশের বাহল শব্দটির 'হ' অক্ষরটি নেই। ইংরেজি বানানে একটি এইচ আছে বটে, কিন্তু তা উচ্চারণে উহ্য থাকবে। ভাষা উচ্চারণের ও ভাষা সংস্কৃতির যে জটিলতার কারণে আমরা স্কুলজীবনেও হেনরির ছোটগল্পের শিরোনামকে বলতাম গিফট অব দ্য মেজাই (রেভঃ ড়ভ ঃযব সধমর), সেই একই কারণে কুনাল বাবুর নাম বাহল বলতে হচ্ছে। যা হোক, সেটা আলোচনার বিষয় নয়। এই কুনাল বাহলের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা মোট ৫০০। এক দিন একজন কর্মচারী সাধারণ মিটিংয়ের সময় তাঁকে জানান, তাঁদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিবনগরের গ্রামবাসীর খাবার পানি আনতে হয় এক কিলোমিটার দূর থেকে। বিষয়টি কুনাল বাহলের মনে আটকে যায়। তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করেন ওই গ্রামে ১৫টি চাপকলের। ছোট্ট ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামটির প্রতিটি বাড়ির মানুষ ৫০ মিটার দূরত্বের মধ্যে খাবার বিশুদ্ধ পানি পেয়ে যায়। গ্রামবাসী আনন্দিত হয়ে, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে গ্রামটির নাম পাল্টে রাখে স্নেইপডিল ডটকম।
পশ্য, পশ্যামি! কুনাল আরো সৌন্দর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি প্রচারমাধ্যমকে বলেছেন, তেমন কিছুই করিনি। অতি সাধারণ চেষ্টা মাত্র। আমাদের পাঁচ হাজার ডলারের সমানও ব্যয় করতে হয়নি। এ সামান্য অর্থ খরচের বিনিময়ে গোটা গ্রামের মানুষ আগামী ২০ বছর পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারবে। আমাদের এ কাজ দিয়ে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন যে জনগণের যত্ন নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেটাই প্রমাণ হয়েছে মাত্র। তিনি বলেছেন, ভারতে ছয় লাখ ৪০ হাজার কম্পানি আছে, যার মধ্যে অসংখ্য কম্পানি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ কম্পানি এগিয়ে এলেই আমরা ভারতের ৬৪ হাজার গ্রামের কোটি কোটি মানুষের পানির সমস্যা দূর করতে পারি।
ইন্টারনেটের সুবাদে এই কাহিনী পড়ে আমার মধ্যে দুটো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। প্রথমত, শত শত কোটি টাকা খরচ করে, রাস্তায় রক্তারক্তি করে নামের দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বদলে ছোট একটু মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে নামকে চিরস্থায়ী করে ফেলা যায়। এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আগে থেকে নামের রাজনীতি মাথায় থাকলে নাম থাকে না, বদনামের বোঝাটাই ভারী হতে থাকে। দ্বিতীয়টি দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে টাকার সমাগম হলে কাউকে বিশুদ্ধ পানি খাওয়ানোর বদলে শাহরুখ খানকে এনে নাচানোর ইচ্ছা জাগে। এ যেন সেই জমিদারির সময়ের হতদরিদ্র প্রজার পিঠে চাবুক মেরে লক্ষ্নৌ থেকে বাইজি এনে নাচানোর আধুনিক সংস্করণ!
শখ-আহ্লাদ-বিনোদন-বিলাসিতা থাকবে। সেটা দোষের কিছু নয়। ব্যক্তিমানুষের যেমন আনন্দ-বিনোদন থাকে, সামষ্টিক বা জাতীয় জীবনেও আনন্দ-বিনোদন-বিলাসিতা থাকে। তবে শখের বা বিলাসিতার সঙ্গে সাধ্যের সংগতি থাকা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচ। সে ম্যাচ উপলক্ষে ঢাকায় যে টিকিট বিক্রি শুরু হতে যাচ্ছে, তার মূল্য ২০ হাজার, ৩০ হাজার টাকা! সর্বনিম্ন টিকিটের মূল্য সাত হাজার ৫০০ টাকা। এ ম্যাচ উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বের হয়ে যাবে! আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়ার এ ম্যাচের আয়োজনের যৌক্তিকতা কোথায়, কেউ বলতে পারেন কি?
প্রথমত, বাংলাদেশ এখন আর কোনোক্রমেই ফুটবলের দেশ নয়। একসময় এ দেশের মানুষ ওয়ান্ডারার্স-মোহামেডান, তারপর আবাহনী-মোহামেডানের খেলা নিয়ে উন্মাদ হয়ে থাকত। তখন সাধারণ মানুষের ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার ফুটবল খেলা দেখার সুযোগ ছিল খুবই কম। প্রযুক্তির সুবাদে এখন ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার ফুটবল দেখে মানুষ স্থানীয় ফুটবল ম্যাচ থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যুব সম্প্রদায় তথা জনতা ভাগ হয়ে গেছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সমর্থক হিসেবে। ভুল করেও কেউ ঢাকা স্টেডিয়ামের পথ মাড়ায় না। মুষ্টিমেয় ফুটবল কর্মকর্তা ছাড়া দর্শক দেখা যায় না। তাঁদেরই খেলা, তাঁদেরই ব্যবসা। বাংলাদেশে বর্তমানে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা থেকে ফুটবলার নামের যে বেকার যুবকদের ধরে এনে খেলানো হচ্ছে, তা এ দেশের যুবকদের মধ্যে সামান্য রেখাপাত করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, এ ম্যাচ থেকে বাংলাদেশ কী শিখবে, কী প্রেরণা পাবে? এ ম্যাচ থেকে কিছু শেখার আশা করা কি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রকে অভিসন্দর্ভ পাঠ করানো নয়? সে যাক। ফুটবল খেলা নিয়ে আর বেশি কিছু না হয় নাই বললাম। কিন্তু প্রশ্ন আমার ওই ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে। এই পরিমাণ টাকা হলে আমি উপকূলের লাখ লাখ মানুষকে জলদস্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারি, অথবা তাদের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা বা নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করতে পারি। ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে আমি জনসংখ্যা বিস্ফোরণ কিছুটা হলেও মোকাবিলা করতে পারি। এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে আমি লাখ লাখ গার্মেন্টকর্মীকে রাষ্ট্রীয় সেবা দিতে পারি, যারা আর্মি অ্যান্টের (এক প্রজাতির দলবদ্ধ পরিশ্রমী পিঁপড়া) মতো দেশের অর্থনীতিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে।
কত ক্ষত চোখের সামনে দগদগ করছে! অফিসে যাতায়াতের পথে কারওয়ান বাজারের আন্ডারপাসে সাত-আট বছরের একটি মিষ্টি চেহারার মেয়েকে ভিক্ষার পাত্র হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখি। অনেকেই মেয়েটিকে সেখানে দেখতে পান। দেখলেই বোঝা যায়, মেয়েটির দুটো চোখই উপড়ে ফেলা হয়েছে (যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে ভুল ধারণা দেওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করছি)। কে যেন ওকে বসিয়ে দিয়ে যায়, আবার সময়মতো নিয়ে যায়। নির্লিপ্ত বসে থাকে সারা দিন। আর্জেন্টিনা দলের তারকা স্ট্রাইকার মেসি যখন ৬ সেপ্টেম্বর ওই রাস্তা দিয়ে গাড়িবহর নিয়ে যাবেন, তখন কি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবেন, সাত-আট বছরের একটি শিক্ষাবঞ্চিত, আহারবঞ্চিত, ক্ষুধার্ত অন্ধ শিশুর মাথার ওপর দিয়ে তিনি নিমেষে পার হয়ে গেলেন? ওই শিশুটি একা নয়, অগণিত অসহায় শিশু বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে একটু ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছে না। শিক্ষা, বাসস্থান, অন্ন-বস্ত্রের মতো অধিকার থেকে রাষ্ট্র তাদের বঞ্চিত করে রেখেছে। মুখে দরিদ্রপ্রেম অন্তরে ধনপূজার যে সংস্কৃতি দেশে চলছে, তার ব্যত্যয় প্রয়োজন। আমার এ নিবন্ধ যাঁরা পড়বেন, যাঁরা ওই ফুটবল ম্যাচটি দেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন_তাঁদের মধ্যে মাত্র একজনের, যদি মনে হয়, সর্বনিম্ন মূল্যের টিকিট না কিনে, দেড় ঘণ্টার একটি ফুটবল ম্যাচ না দেখে ওই শিশুটির সাহায্যে এগিয়ে যাবেন, তাহলে বদলে যাবে একটি নিরীহ, নির্দোষ শিশুর জীবন (যে শিশুকে অসহায় করে রেখেছে দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কৃতি), বর্তে যাবে আমার এ লেখা!
লেখক : সাংবাদিক, mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.