স্মরণ-আমার দেখা গৌরবাবু by জগদীশ চন্দ্র ঘোষ

আমার চলার পথের এক বাঁকে হঠাৎ একদিন সাক্ষাৎ হলো গৌর চন্দ্র বালার সঙ্গে। সেই বাঁকটার কথা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। ফরিদপুরের তৎকালীন প্রথিতযশা অ্যাডভোকেট প্রফুল কুমার ঘোষ মহাশয়ের বাড়িতে অ্যাডভোকেট নীলকমল সরকারের উপস্থিতিতে। গৌর চন্দ্র বালা মহাশয় তখন একজন সুপরিচিত ব্যক্তি। কারণ এর আগে যুক্তফ্রন্ট সরকারের অধীনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তিনি একজন মন্ত্রী ছিলেন।


পরে পাকিস্তান সরকারের এমএলএ-ও হয়েছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে আলাপকালে তাঁর অতি মার্জিত, সপ্রতিভ ও অমায়িক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সেই প্রথম সাক্ষাতের পর তাঁর সঙ্গে পথেঘাটে বহুবার আমাদের দেখা হয়েছে। প্রতিবারই তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ বিনম্র হাস্যে নমস্কার করে আমাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। আগে থেকে তাঁকে নমস্কার জানানোর সুযোগ আমি কোনো দিনও পাইনি। রাজনীতির হালচাল দেখে মনে হয়, বিশেষ করে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে, এর দুটি অর্থ হতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে বিচিত্র, বিভিন্ন বিধিবিধান প্রণয়ন করে দেশ ও জাতির সম্পদ লুণ্ঠন এবং নেতৃত্বের পরিমণ্ডলে সম্পদের পাহাড় গড়ে ভোগবিলাসের সর্ববিধ আয়োজনে সর্বদা ব্যাপৃত থাকা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে শ্রেষ্ঠ নীতির বাস্তবায়নে আ@ে@@@াৎসর্গ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে সর্বদা নিয়োজিত থাকা। গৌরবাবু ছিলেন দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিক। তাই আজীবন কৃচ্ছ্র সাধনের মধ্যেই ঘটেছে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি। অত্যন্ত সহজ সাধারণ আটপৌরে জীবনযাপন করতেন তিনি। নিজে সম্পদ না করলেও পাঁচ ছেলেমেয়েকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। পেশায় তিনি ছিলেন আইন ব্যবসায়ী। কিন্তু কখনোই তিনি আইন ব্যবসার দিকে যেমন পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেননি রাজনীতির আকর্ষণে, অন্যদিকে রাজনীতির সহজ, সরল পথে চলতে গিয়ে লক্ষ্মীর প্রসাদ থেকে নিজেকে করেছেন বঞ্চিত, হয়েছেন লাঞ্ছিত ও প্রতারিত। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ভারতের এককালের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কথা। অত বড় একটা বিশাল রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী, অথচ মহাপ্রয়াণের পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য রাষ্ট্রের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল তাঁর উত্তরপুরুষদের। রাজনৈতিক কূটচালে গৌরবাবু ছিলেন একেবারেই অনভ্যস্ত। তাই সহজ পথে চলতে গিয়ে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তাঁর জীবনে নেমে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেও নিজের দলের শকুনিদের সঙ্গে রাজনীতির পাশা খেলায় তিনি হলেন পরাভূত। আর এভাবেই ষড়যন্ত্র, কপটতা আর ভণ্ডামির কাছে একটি দেশপ্রেমিক, মানবদরদি আদর্শ জীবনের ঘটল বেদনাময় পরিসমাপ্তি!
আমরা জাতি হিসেবে এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী। আমাদের অনেক গৌরব আছে, আছে অনেক ঐতিহ্য। কিন্তু এ গৌরব ও ঐতিহ্য একদিনে বা কোনো একক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় হয়নি। এর পেছনে অগণন ভালো মানুষের বিন্দু বিন্দু শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতা কাজ করেছে। কিন্তু জাতিগতভাবে আমাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা আমাদের মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের স্মরণ ও মূল্যায়নে কেন যেন অকারণ কার্পণ্য দেখাই। আমরা কথায় কথা বিলি, 'যে জাতি তার বীর সন্তানদের মর্যাদা দিতে পারে না, সে জাতি বীর সন্তান পায় না।' কিন্তু এ কথাগুলো যতটাই আমরা বুলি হিসেবে ব্যবহার করি, কার্যক্ষেত্রে তার বাস্তব প্রয়োগ খুব সামান্যই দেখাতে পারি। বরং অকারণ বিতর্ক তুলে এনে কীর্তিমানদের বিতর্কিত করে তোলার প্রয়াস পাই। এ আত্মঘাতী প্রবণতা আজও আমরা বহন করে বেড়াচ্ছি। গৌরবাবু আর আমাদের মাঝে নেই। পাঁচ বছর আগে ২০০৫ সালের ১৮ জুন তিনি এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মঙ্গলালোকে চলে যান। আমাদের জন্য রেখে যান একটি আদর্শের প্রতিকৃতি। তিনি সর্বদা আমাদের পাথেয় হয়ে আছেন। আমরা কাজকর্মে যদি তাঁর আদর্শ অনুসরণ করতে পারি তবেই তাঁর প্রতি জানানো হবে প্রকৃত শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার শাশ্বত শান্তি হোক-এটাই আমার একান্ত কামনা।
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ

No comments

Powered by Blogger.