চরাচর-ভালোবাসার প্রতীক প্রেম কানন by আলম শাইন

একসময় এ দেশে জমিদারি প্রথা ছিল। জানা যায়, জমিদাররা নানা ধরনের খেয়ালি মনোভাবের অধিকারী ছিলেন। তাঁদের খেয়ালখুশিও ছিল বৈচিত্র্যময়। কেউ কাঙালের ধন লুটে নিতেন, কেউ বা নিজের ধন কাঙালের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। একেকজন একেক ধরনের কাজে তৃপ্তি পেতেন।


তবে বেশির ভাগ জমিদার জনহিতকর কাজে লিপ্ত ছিলেন। কেন যে ইতিহাস তা চেপে যাচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। আমাদের দেশের ইতিহাস জমিদার বলতে একজন হিংস্র চক্ষু রাঙানো মানুষকে বোঝাচ্ছে। আসলে যে সবাই এমনটি ছিলেন না তার প্রমাণ দিয়েছেন খুলনা জেলার জোড়াগেট নামক স্থানের জমিদার শ্রীমঙ্গলচাঁদ চুনিলাল। তিনি ছিলেন মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের। বেশ অর্থকড়ির মালিক ছিলেন এবং ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। জমিদার বাবু একবার পুণ্যকাজে তীর্থে (বৃন্দাবন) গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে শ্রীকৃষ্ণ-রাধার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় নিবেদিত হয়ে তাঁদের স্মৃতিতে গড়ে তোলেন 'প্রেম কানন' নামের একটি উদ্যান। সেখানে তিনি আজীবন শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজে বেড়ান নিজের গড়া উদ্যানে। বাংলা ১৩৩৫ সালে প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমির ওপর জোড়াগেটে এই উদ্যানটি বানিয়েছেন তিনি। পুরো উদ্যান উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন। প্রেম কাননের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ফটকটি। বেশ বড় এবং কারুকার্যময় এটি। ফটকের গায়ে ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি মিলিয়ে তিনটি ভাষায় লেখা রয়েছে 'প্রেম কানন'। এখানকার শান্ত-নিবিড় পরিবেশ দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয় নিমেষেই। বাগানে প্রবেশ করলে সুনসান নীরবতায় যে কারোরই মন ভক্তিতে ভরে ওঠে তাৎক্ষণিকভাবে। বাগানের ভেতর প্রবেশপথটিও বেশ সুন্দর। দুই পাশ হরেক রকম পাতাবাহার গাছে সজ্জিত। এর দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরের চারপাশে আছে নানা প্রজাতির গাছগাছালি। শান বাঁধানো পুকুরঘাটটি পাকা ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত। ঘাটের পাশেই রয়েছে ছোট আকৃতির দুটি ঘর। একটি ঘরে রয়েছে ছোট আকারের একটি রথ। শ্রাবণ মাসে রথ উৎসবের সময় জগন্নাথ দেবকে রথে বসিয়ে প্রেম কাননের চারদিকে ঘুরিয়ে দোলখোলার শীতলাবাড়ির মন্দির পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রেম কাননের মূল বাগানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফুল ও ফলের গাছ। উল্লেখযোগ্য ফুলগাছের মধ্যে রয়েছে জুঁই, চাঁপা, কেয়া, শিউলিসহ নাম না জানা অনেক ফুল ও ফলের গাছ। ফলগাছের মধ্যে রয়েছে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, নারিকেল, খেজুর ইত্যাদি। এখানে ইচ্ছা করলেই যখন তখন প্রবেশ করা যায় না। মূলত বিকেল ৩টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। কঠোর নিরাপত্তার ফলে ইচ্ছা করলেই কেউই যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটাতে পারেন না। বিশেষ করে দেবদেবীর লীলাস্থলে কেউ বখাটেপনার সাহসও পান না। এলাকাবাসী খুশি তাতে। তাদের কামনা, জমিদার শ্রীমঙ্গলচাঁদ চুনিলালের এমন একটি ঐতিহ্যবাহী উদ্যান যেন আজীবন স্মৃতি হয়ে থাকে জোড়াগেটে। যেন এই সম্পত্তির প্রতি কারো লোভাতুর দৃষ্টি না পড়ে। এলাকাবাসীর সঙ্গে সে কামনা আমাদেরও। কারণ এটি এখন দেশের সম্পদ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য। কাজেই প্রশাসনকেই দায়িত্ব নিতে হবে এটি রক্ষণাবেক্ষণের।
আলম শাইন

No comments

Powered by Blogger.