ফয়েজ, তুই যা আমিও আসছি by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

এম আর আখতার মুকুলের মৃত্যুর পর ফয়েজ আহ্‌মদ লিখেছিলেন, 'মুকুল তুই যা, আমিও আসছি।' সেই প্রতিশ্রুতি এত দিনে পূরণ করলেন ফয়েজ। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা গতবার যখন ঢাকায় এসেছিলাম, তখন। তখনই দেখেছিলাম জরাজীর্ণ শরীর। বলেছিলেন, 'তোর সংবর্ধনা সভায় এলাম গাড়ি পেয়েছি বলে। কে কখন চলে যাই ঠিক নেই।


হয়তো এটাই শেষ দেখা।' তাঁর কথাই সত্য হলো। আমি সোমবারই (২০ ফেব্রুয়ারি) সিঙ্গাপুর থেকে মাত্র এক দিনের জন্য ঢাকায় পৌঁছেছি। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই জানলাম, ফয়েজ নেই। আমার চেয়ে বয়সে দুই-তিন বছরের বড় এই ফয়েজের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সেই পঞ্চাশের দশক থেকে। তখনই তিনি শিশুসাহিত্যিক হিসেবে বিখ্যাত। তাঁর পত্রিকাটির নাম ছিল মাসিক হুল্লোড়। সম্ভবত সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম শিশু মাসিক ছিল এই হুল্লোড়।
ছড়া লেখক হিসেবে ফয়েজের তুলনা ছিল না। এমনকি রাজনৈতিক ছড়াতেও তিনি অসাধারণ। জীবনের প্রথম পর্ব থেকেই ফয়েজ বামপন্থী। তাঁর মতো অসাম্প্রদায়িক এবং বাঙালি চেতনায় উজ্জীবিত সাংবাদিক আমি কম দেখেছি। বামপন্থী সাংবাদিক হিসেবে পাকিস্তান সরকার তাঁকে সাত বছর জেলে আটকে রেখেছিল। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি দৈনিক আজাদে চিফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এর আগে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনালগ্ন থেকে তিনি ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার ছিলেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় তাঁর অসাধারণ রিপোর্টিং প্রতিভার পরিচয় প্রকাশ পায়। মওলানা ভাসানী নির্বাচনী প্রচার উপলক্ষে ওই সময় সারা পূর্ব পাকিস্তানে ঝটিকা সফর করছেন। তখন ফ্যাঙ্ ছিল না, টেলিফোনের সুবিধা ছিল না। গ্রামাঞ্চল থেকে খবর পাঠানো ছিল অসম্ভব ব্যাপার। মওলানা ভাসানী তাঁকে এত বিশ্বাস করতেন যে তাঁর বক্তব্যের ব্রিফিং দিয়ে সাদা কাগজে সই করে দিতেন। বলতেন, 'ফয়েজ, তুমি যখনই শুনবে আমি কোথাও বক্তৃতা করেছি, তখন আমি কী বলব তুমি জানো। আমার সই করা এই সাদা কাগজে আমার বক্তব্য লিখে কাগজে কাগজে পাঠিয়ে দেবে।' আমরা বিস্মিত হয়ে দেখতাম, মওলানা সাহেব যেসব কথা বহু দূর অঞ্চলে বলেছেন এবং পরে আমাদের হাতে এসেছে, তার সঙ্গে ফয়েজের পাঠানো রিপোর্টের কোনো গরমিল নেই।
ফয়েজ বেশ কিছুদিন চীনে ছিলেন সিনহুয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে। ফলে গভীরভাবে চীনা-মাওবাদী রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। কিন্তু এর ফলে বাঙালি সেক্যুলার সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে তাঁর বিচ্যুতি ঘটেনি। ভাষা আন্দোলন থেকে রবীন্দ্রসংগীত রক্ষা, বাংলা হরফ রক্ষা_এমন কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন নেই, যার সঙ্গে ফয়েজ যুক্ত ছিলেন না অথবা নেতৃত্ব দেননি। পাকিস্তান আমলে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে যখন তথাকথিত তমদ্দুনি সাহিত্যের প্রবল দাপট, তখন তরুণ প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীরা সেক্যুলার জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। এই সংস্থার সভাপতি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহ্‌মদ।
ফয়েজ আহ্‌মদ এরশাদের শাসনামলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক মতাদর্শে গরমিল ছিল। কিন্তু তাতে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক সামান্যও ক্ষুণ্ন হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন একান্ত অসহায়ভাবে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছি, তখন সবার আগে ফয়েজ এসে আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। আমার স্ত্রীর দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে লন্ডন যাওয়ার সময় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে এমন অক্লান্ত সৈনিক আমি আর দেখিনি।
আমি ঢাকায় এসেছি শুনলে এই বার্ধক্যজনিত অক্ষমতা সত্ত্বেও তিনি ছুটে আসতেন। ঢাকায় একটি গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এই গ্যালারির দুটি মূল্যবান পেইন্টিং তিনি আমার এক মেয়েকে উপহার দিয়েছিলেন। শুধু রিপোর্টার হিসেবে নয়, সম্পাদক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে তিনি স্বরাজ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর অসাধারণ সাংবাদিকতার প্রকাশ ঘটেছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি প্রেস ক্লাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের গোলাবর্ষণে আহত হয়েছিলেন। অল্পের জন্য তিনি রক্ষা পান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় দৈনিক বঙ্গবার্তা নামে যে দৈনিক পত্রিকাটি বের হয়, তার সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহ্‌মদ। বাসসের প্রথম প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল তাঁর অসম্ভব ঘনিষ্ঠতা। বঙ্গবন্ধু তিনজন সাংবাদিককে ঠাট্টা করে তিনটি নাম দিয়েছিলেন। আমাকে বলতেন আপদ, মূসাকে বিপদ আর ফয়েজের নাম ছিল মুসিবত। বলতেন, 'আমার আপদ, বিপদ, মুসিবত হচ্ছে এই তিনজন।'
ফয়েজের গদ্যের ভাষাও ছিল অসাধারণ। তাঁর মধ্যরাতের অশ্বারোহী বইটি শুধু মনোজ্ঞ স্মৃতিকথা নয়, তৎকালীন সংবাদ সাহিত্যের একটি অসাধারণ চিত্র। যেকোনো বই প্রকাশিত হলেই ফয়েজ আমাকে তার কপি পাঠাতেন। সে বই এখন আর তিনি পাঠাবেন না। এখন একমাত্র এ বি এম মূসা ছাড়া শত্রুতা কিংবা মিত্রতা করার মতো আর কোনো বন্ধু আমার রইল না। এখন আমার মন স্মৃতি ভারাক্রান্ত। অনেক কথাই মনে আসে, যা এখন লিখতে পারব না। পরে গুছিয়ে লিখব। এখন ফয়েজের ভাষাতেই বলি, 'ফয়েজ, তুই যা আমিও আসছি।'
ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.