ইতিউতি-নারী নির্যাতনে নিকৃষ্ট দেশ by আতাউস সামাদ

পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের সাম্প্রতিক একটি ভাষণের বিস্তারিত বিবরণ খুঁজছিলাম ইন্টারনেটে। প্রথম চেষ্টায় সফল হইনি। পরে হাতে সময় নিয়ে খোঁজ করতে হবে। দিন আট-দশেক আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ রোমান ক্যাথলিক দেশ ক্রোয়েশিয়া সফরে গিয়ে পোপ বেনেডিক্ট আহ্বান জানিয়েছেন ব্যক্তিজীবনে খ্রিস্টান ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে ফিরে আসতে।


তিনি বলেছেন, ইউরোপের সমাজগুলো অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় সেসব থেকে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি বলতে গেলে উঠে গেছে। এর ফলে মানুষকে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো লোক যখন মনের অশান্তিতে ভোগে, তখন শান্তি অথবা সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য সে অন্য কারো সহায়তা ও সাহায্য পায় না। কারণ পরিবার না থাকায় কাছের মানুষ বলেও কেউ আর নেই। পোপ বেনেডিক্ট উপদেশ দিয়েছেন, এই শূন্যতা ও বেদনাকাতর অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার পথ হলো আবার পরিবার গড়া। পোপ বেনেডিক্ট বলেছেন, সে জন্য নারী ও মানুষকে বৈধভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে এবং সন্তান জন্ম দিতে হবে। এখনকার মতো 'লিভ টুগেদার' (বিয়ে না করেও নর-নারীর একে অপরের অংশীদার হিসেবে বসবাস) করা এবং তেমন করতে সুবিধা হবে চিন্তা করে সন্তান না নেওয়ার কৌশল অশান্তি বাড়িয়েই চলবে। তিনি বলেন, এখন এ পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর সময় এসে গেছে।
পোপ বেনেডিক্ট কিছুদিন ধরেই ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্মীয় মূল্যবোধের আদর্শ পুনঃ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। ক্রোয়েশিয়ার অধিকাংশ অধিবাসী রোমান ক্যাথলিক হওয়ায় দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউতে যোগ দেওয়ার প্রশ্নে সেখানে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ইইউ তার নীতি ও কাজকর্মে তার ভাষায় যুক্তিবাদী। অন্যদের মতে, ওই প্রতিষ্ঠানে ধর্ম থেকে উদ্ভূত ধ্যান-ধারণার স্থান নেই। অথচ ইউরোপে এখন ইইউ সব দিক দিয়ে প্রভাবশালী। পোপ বেনেডিক্ট ক্রোয়েশিয়ার ধর্মপরায়ণ রোমান ক্যাথলিকদের উপদেশ দিয়েছেন যে এতদসত্ত্বেও তাদের দেশকে ইইউতে যোগ দিতে হবে। (অন্য অনেকবারের মতো এবারও ওপরের কথাগুলো একাধিক সূত্র ও স্মৃতি থেকে নেওয়া। তাই পোপের মন্তব্য উদ্ধৃত করতে গিয়ে কোথাও কোথাও কিছুটা গরমিল থাকতে পারে। তবে মূল কথা ঠিক আছে বলেই আমার বিশ্বাস।)
তবে আমি যে জন্য পোপ বেনেডিক্টের মন্তব্যের বিস্তারিত খুঁজছিলাম, তার কারণ অন্য। তাঁর এই ভাষণটি সম্পর্কে আমি সর্বপ্রথম ঢাকার যে বাংলা পত্রিকায় পড়ি, তাতে লেখা হয়েছিল-তিনি ইউরোপকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' থেকে সরে এসে ধর্মীয় মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তখন আমার ধারণা হয়েছিল যে ইংরেজি ভাষ্যে সম্ভবত 'ঝবপঁষধৎরংস' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বিবিসি অভিধানে দেখতে পাই, 'সেক্যুলারিজম' শব্দটির মূল অর্থ ছিল ইহজাগতিক বা পার্থিব। তবে শব্দটির রাজনৈতিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে এর ব্যবহার বেশি হচ্ছে রাজনীতিতে বা রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসনের চিন্তাধারা বা প্রভাব দূরে রাখাকে। এ ক্ষেত্রে বস্তুকেন্দ্রিক বা বৈষয়িক বিবেচনাই প্রাধান্য পাবে। অভিধানের ব্যাখ্যা মতোই একটা ধারণা মনে গাঁথা ছিল বলে পোপ 'সেক্যুলারিজম' শব্দটি ব্যবহার করেছেন কি না এবং সে ক্ষেত্রে পোপ 'ধর্মনিরপেক্ষতা' অর্থে শব্দটি ব্যবহার করে থাকলে তা ধর্মচিন্তা বনাম বস্তুবাদ বা ইন্দ্রিয়বাদ অর্থে করেছেন, না রাষ্ট্রে কোনো ধর্মকে বিশেষ স্থান না দেওয়ার কথা বলেছেন, তা বোঝার জন্যই তাঁর ভাষণের পূর্ণ ইংরেজি ভাষ্যটি খোঁজ করছিলাম। ইন্টারনেটে সেই ভাষ্য চট-জলদি খুঁজে পাইনি, তবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাঁর ভাষণের অংশবিশেষ পড়ে মনে হলো, তিনি মানুষের ভরসার স্থান হিসেবে ধর্মীয় অনুশাসন ও ঐতিহ্য মোতাবেক পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধশূন্য আত্মকেন্দ্রিক এবং শুধুই বস্তুবাদী সমাজ বোঝাতে 'সেক্যুলার' কথাটি ব্যবহার করেছেন।
ইদানীং বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলাম ধর্মের কোনো উল্লেখ থাকবে নাকি ১৯৭২ সালে গণপরিষদে গৃহীত সংবিধানে যেভাবে বলা হয়েছিল-বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি হবে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' (অন্য তিনটি ছিল গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র) সেই অবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে, এ নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমার জানতে ইচ্ছা হয়েছিল, পোপ বেনেডিক্ট 'সেক্যুলারিজম' ও ধর্মীয় মূল্যবোধের তুলনা কিভাবে করেছেন তা জানার। আরেকটা কারণ ছিল, ইইউর সদস্য পদপ্রার্থী তুরস্কে এই সেদিন জাতীয় নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো যিনি সরকার প্রধান হলেন, সেই রেসেপে তাইয়িপ এরদেগান খুব স্পষ্ট করেই বলে থাকেন, যেহেতু সমাজকে ধর্মবিশ্বাস ও চিন্তা প্রভাবিত করে আর রাজনীতি হয় সমাজকে কেন্দ্র করে, অতএব রাজনীতি থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা একটা ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। তুরস্কের এই নেতা নরমপন্থী ইসলামিক বিশ্বাসী বলে পরিচিত। যদিও তুরস্কের সংবিধানে দেশটি স্যাকুলার বলে স্বীকৃত তবুও তিনি ইইউতে সদস্যপদ পাওয়ার জন্য তিনি তুরস্কের রাজনীতি থেকে ইসলামী মূল্যবোধ বা ধর্মচিন্তার প্রভাবকে দেশছাড়া করতে রাজি হচ্ছেন না বলে শুনেছি। স্বভাবতই একই সময়ে একদিকে পোপ বেনেডিক্ট, আরেকদিকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও অনুশাসনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ইউরোপের রাজনীতিতে কী প্রতিক্রিয়া দৃষ্টি করে, তা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিষয় হতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের অঙ্গরাজ্য, আমাদের লাগোয়া ভারতীয় এলাকা, পশ্চিমবঙ্গে কয়েক যুগের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট নির্বাচনে যে তৃণমূল দলের প্রধান মমতা ব্যানার্জির রাজনীতির কাছে একেবারে গো-হারা হেরে গেল, তাতেও ধর্মভিত্তিক সংখ্যালঘু মুসলমানদের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদী সিপিএম সরকার এত দিন আমলেই নেয়নি যে পশ্চিমবঙ্গের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা লেখাপড়া ও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই পিছিয়ে পড়েছেন। মমতা ব্যানার্জি তাঁদের প্রতি সুবিচার করার আশ্বাস দেন। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলিমরা তাঁর দলের প্রার্থীদের প্রায় একজোটে ভোট দিয়েছেন। মমতা ব্যানার্জিও মুখ্যমন্ত্রী হয়েই ১০ হাজার মাদ্রাসাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে আমি এখানে ধর্ম বিবেচনা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধ বনাম বস্তুবাদ বা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বিতর্ক জুড়ে দেওয়ার জন্য এসব কথা লিখছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধুদের আমি সম্মান করি এবং একই সঙ্গে ধর্মবিষয়ক বা ধর্মভিত্তিক কোনো বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে আমি ভয় পাই। আর আমি এ কথা খুব ভালোভাবে জানি, শুধুই ধর্ম বা শুধুই অন্য কোনো তন্ত্র কোনো রাষ্ট্র এবং সমাজের সব সমস্যা সমাধান করে না।
যে জন্য শুরুতে পোপ বেনেডিক্টের একটা ভাষণ নিয়ে এ কথা-সেটা এ ক্ষেত্রে কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অন্য একটা বিষয়। পোপের ভাষণের রিপোর্ট খুঁজতে গিয়ে ইন্টারনেটে আকস্মিকভাবে দেখা পেলাম একটি সমীক্ষার, যার শিরোনাম ছিল-'বিশ্বে নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ'। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে টমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের ট্রাস্ট ল' নামে আইনি বিষয়ের একটি বার্তা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের পাঁচটি মহাদেশের ২১৭ জন জেন্ডার-বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে এই বার্তা প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তান, কঙ্গো ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক, পাকিস্তান, ভারত ও সোমালিয়াকে 'নারী হিসেবে জন্মানোর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ' হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওপরের তালিকাটি সর্বনিকৃষ্টের ক্রম অনুসারে সাজানো, অর্থাৎ আফগানিস্তান হচ্ছে মেয়েদের জন্য সবচেয়ে খারাপ দেশ। এই মূল্যায়নের জন্য ট্রাস্ট ল' মতদানকারী বিশেষজ্ঞদের যে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে বলেছিল সেগুলো হচ্ছে-যৌন নিপীড়ন বা সহিংসতা, যৌন কারণবহির্ভূত নারী নির্যাতন, সংস্কৃতিগত বা ধর্ম-সংক্রান্ত কোনো কারণ, বৈষম্য (নারী-পুরুষ), সম্পদ ও সুবিধা (যেমন-শিক্ষা, কর্মসংস্থান) না পাওয়া এবং নারী পাচার ব্যবসা। ওই প্রতিবেদনটি িি.িঃৎঁংঃড়ৎম/ ঃৎঁংঃষধ/িড়িসবহংৎরমযঃ ঠিকানায় ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের বিষয়ে উদ্বেগজনক ঘটনার খবর আমরা প্রায়ই পাই। তবু এ কথা ভেবে আমার ভালো লাগছে যে আমাদের দেশ উলি্লখিত সর্বনিকৃষ্টদের মধ্যে একটি নয়। তবে এ বিষয়ে সত্যিকার ভালো দেশ হওয়ার জন্য আমাদের আরো এগোতে হবে। সাবধান থাকতে হবে এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য একাগ্র হতে হবে-এই আমার বিশ্বাস।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.