এক মহীয়সীর কথা by ডা. ওয়াহিদ নবি

কবিগুরু বলেছিলেন, 'প্রতিভা মানুষের সমস্তটা নহে, তাহা মানুষের একাংশমাত্র। প্রতিভা মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের মতো; আর মনুষ্যত্ব চরিত্রের দিবালোক, তাহা সর্বত্রব্যাপী ও স্থির।' বেগম সুফিয়া কামালের কবি-প্রতিভা বিস্ময়কর। আমাদের কাছে কবি হিসেবে তিনি বরেণ্য, কিন্তু আমাদের অনেকের কাছে তিনি শুধু কবি হিসেবেই বরেণ্য।


অথচ আমরা যদি তাঁর সুদীর্ঘ ৮৯ বছরের ব্যস্ত কর্মজীবনের দিকে তাকাই, তবে বুঝব রবীন্দ্রনাথের উক্তির মর্মকথা। কবিতা রচনার সঙ্গে সঙ্গে, সাহিত্য সাধনার সঙ্গে সঙ্গে কতভাবে তিনি মনুষ্যত্বের সেবা করেছেন তা বিস্ময়কর। অবশ্যই তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা বিস্ময়কর, কিন্তু তারও চেয়ে বড় ছিল প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে তাঁর অকুতোভয় সংগ্রাম। তিনি নিজে লড়েছেন। সেসব লড়াইতে সঙ্গে নিয়েছেন বঞ্চিতদের। অনুপ্রাণিত করেছেন অন্যদের। এ জন্যই তিনি মহীয়সী। ১৯১১ সালে তাঁর জন্ম। মুসলমান মহিলারা তখন পর্দা নামক শৃঙ্খলে বাঁধা। জমিদার-জাতীয় অভিজাত পরিবারে এই পর্দা ওজনে আরো ভারী। রক্ষণশীলতা মুসলমান নারীদের বঞ্চিত করত শিক্ষার আশীর্বাদ থেকে। পরনির্ভরশীলতাকেই নারীদের বড় গুণ হিসেবে গণ্য করা হতো তখন। এই পরিবেশেই বাংলা, উর্দু, আরবি ও ফার্সি শিখে ফেললেন তিনি গৃহশিক্ষকের সহায়তায়। মা ও মামার কাছে বাংলায় পেলেন বিশেষ শিক্ষা। শিক্ষার প্রতি, বিশেষ করে নারী-শিক্ষার প্রতি তাঁর পরিবারের আগ্রহ তাঁকে সাহায্য করেছিল সে যুগে। বাল্যবিবাহ সে যুগে বিরল ছিল না। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তাঁর বিয়ে হলো মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে। নেহাল ছিলেন উদার চরিত্রের। তিনি সুফিয়াকে সাহিত্যচর্চা ও সামাজিক কার্যকলাপে অংশ নিতে উৎসাহী করেন। সমাজের অসহায় নারীদের সাহায্য করতে তিনি এগিয়ে আসেন। পর্দার বন্ধন সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন করা সম্ভব ছিল না সে যুগে। মনের অসামান্য দৃঢ়তার জন্যই তিনি পারলেন সীমিত সুযোগের ব্যবহার করতে। পর্দার বন্ধন তাঁর কর্তব্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হলো না। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকল তাঁর সাহিত্য সাধনা। ১২ বছর বয়সেই তিনি লিখে ফেললেন 'সৈনিক বধূ' নামে একটি ছোটগল্প, যা 'তরুণ' নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো। মানুষের জীবনে দৈবাৎ কিছু ঘটে, যা মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। কিন্তু যদি বিশেষ ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটতেই থাকে, তবে বুঝতে হবে এগুলো হঠাৎ ঘটেনি। বেশ কয়েকজন বড় প্রতিভার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় কম বয়সেই, যা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে। ১৪ বছর বয়সের সময় সাক্ষাৎ হয় মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি চরকায় সুতা কাটেন। 'মাতৃ-মঙ্গল' নামের একটি সংগঠনের তিনি সদস্য হন। এই সংগঠনটি মহিলাদের কল্যাণে নিয়োজিত ছিল। সংগঠনের কাজ এই শুরু। পরবর্তী সময়ে তিনি অনেক সংগঠনের সদস্য হয়েছিলেন মানবকল্যাণে, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় বাস করতে গেলে সেখানে কবি নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। নজরুল সুফিয়ার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন এবং কবিতা লিখতে উৎসাহ দেন। তাঁর মাত্র ১৫ বছর বয়সের সময় তখনকার দিনের প্রগতিমনা সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত প্রগতিশীল পত্রিকা সওগাতে তাঁর প্রথম কবিতা 'বাসন্তি' প্রকাশিত হয়।
রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন মুসলিম জাগরণের পথ-প্রদর্শক। আজীবন সুফিয়া ছিলেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বেগম সুফিয়া ১৯২৯ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সংগঠন 'আঞ্জুমান-ই খাওয়াতিন-ই-ইসলাম'-এ যোগ দেন। এই সংগঠনে নারী কল্যাণ বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও সেবামূলক কাজে জড়িত ছিল এই সংগঠন। বেগম রোকেয়ার আদর্শে চিরদিন অনুপ্রাণিত হয়েছেন বেগম সুফিয়া। বেগম রোকেয়া সম্পর্কে কয়েকটি কবিতা তিনি রচনা করেছিলেন। 'মৃত্তিকার গান' নামে একটি কবিতাগ্রন্থ তিনি বেগম রোকেয়ার নামে উৎসর্গ করেন। তিনি 'রোকেয়া সাখাওয়াৎ স্মৃতি কমিটি' গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই সংগঠনের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম 'রোকেয়া হল' রাখা হয়। কোনো মহিলার নামে একটি হলের নামকরণ এই প্রথম। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি তাঁর স্বামীকে হারান। তখনকার দিনের দুরারোগ্য ব্যাধি যক্ষ্মায় মৃত্যুমুখে পতিত হন নেহাল হোসেন। অকাল বৈধব্যের যন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি বৈধব্যের অসহায়তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। শ্বশুরবাড়িতে নিরুপায় বিধবার ভূমিকা না নিয়ে তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে একমাত্র কন্যাকে নিয়ে। একটি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতার কাজ করেন। এ সময় তিনি পরিচিত হন কবি আবদুল কাদের ও কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে, যার নাম ছিল 'সাঁঝের মায়া'। বইটি পড়ে কবি নজরুল তাঁকে 'বাংলার কাব্য গগনে নব উদিত তারা' বলে প্রশংসা করেন। বইটি পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লেখেন, 'বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উচ্চে এবং ধ্রুব তোমার প্রতিষ্ঠা।' লেখক ও অনুবাদক কামাল উদ্দিন আহমদের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৩৯ সালে এবং এই সূত্রে তিনি হাবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন্নাহার মাহমুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। কিন্তু তাঁর সাহিত্য ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় দাঙ্গার শিকারদের অক্লান্তভাবে সাহায্য করেন। এরপর তাঁর পরিবার ঢাকায় চলে আসে। মহিলাদের প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বেগম'-এর তিনি প্রথম সম্পাদিকা। এরপর তিনি জাহানারা আরজুর সঙ্গে 'সুলতানা' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
প্রায় এক ডজন কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা তিনি। 'এ কালে আমাদের কাল' নামে তিনি একটি আত্মজীবনীমূলক বই লেখেন। তিনি ছোটগল্প ও ছোট উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখা ইংরেজি, রুশ, পোলিশ, জার্মান, ইতালিয়ান, ভিয়েতনামিজ, উর্দু, হিন্দি এবং অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য। বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে তিনি পাকিস্তান সরকারের দেওয়া 'তমঘায়ে ইমতিয়াজ' উপাধি ফিরিয়ে দেন। তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পদকসহ প্রায় ৫০টি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এগুলো বিশাল সম্মান, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তিনি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তিনি সংগঠনের মাধ্যমে মানুষকে মানবতার বন্ধনে বেঁধে রেখেছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে 'শান্তি কমিটি'তে যোগ দেন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য। 'পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতির' তিনি প্রথম সভানেত্রী ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদ্যাপনের সময় তিনি 'সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন'-এর নেতৃত্ব দেন। 'বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ'-এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী। কবিগুরু বলেছিলেন, 'মহাত্মাদের প্রতি মাঝেমধ্যে দৃষ্টিপাত করা আমাদের নিতান্ত আবশ্যক। মহাত্মাদের জীবন আলোচনা করলে মনুষ্যত্ব যে কী তাহা বুঝিতে পারি।' বেগম সুফিয়া কামাল আমাদের আলোকবর্তিকা ।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.